ফিরে দেখা ও এগিয়ে চলা: প্রসঙ্গ গ্রেটার কোচবিহার আন্দোলন
শুভজয় রায় (গবেষক)
রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় (ইতিহাস বিভাগ)
suvojoyroy.07@gmail.com
প্রত্যেকটি জাতিরই একটি নির্দিষ্ট গৌরব উজ্জ্বল সংস্কৃতি রয়েছে । বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি বিভাগের কোচবিহার জেলার আদি প্রাচীন বাসিন্দা কোচ রাজবংশী জাতির গৌরবময় সংস্কৃতি মহাভারতেও উল্লেখ আছে, কিন্তু ভারতবর্ষের স্বাধীন হওয়ার পরবর্তীতে কোচবিহার নামক দেশীয় রাজ্যটি 1949 খ্রিস্টাব্দে ভারত ভুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করার মধ্য দিয়ে নানান নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও দেশভাগজনিত কারণে এবং পূর্ববঙ্গের প্রচুর বাসিন্দাদের প্রবেশের ফলে কোচবিহারের নিজস্ব সংস্কৃতির ওপর একটি চরম আঘাত নেমে আসে। যা ক্রমাগত তাদের নিজের সংস্কৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এরই ফলস্বরুপ শেষ পর্যন্ত কোচ সংস্কৃতির পূর্ব গৌরব পুনরুদ্ধার ও নিজ জাতিকে সংরক্ষণের তাগিদে 1997-98 সালের একটি আলাদা রাজ্যের দাবিতে কোচ রাজবংশী জনগণ গ্রেটার কোচবিহার নামক একটি আন্দোলনের সূচনা করেন। ক্রমাগত কয়েকটি পর্যায়ে এই আন্দোলন ঘটে ছিল এবং বর্তমানেও কখনো কখনো পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন আন্দোলন যেমন- গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন, কামতাপুরি আন্দোলন প্রভৃতি এর মত এই আন্দোলন পরিলক্ষিত হয়। এই গ্রেটার কোচবিহার আন্দোলনের কারণ ও প্রেক্ষাপটই তথা সার্বিক আলোচনা আমার এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়।
আন্দোলন সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন এসে যায়। যেমন –
১/এই আন্দোলনের প্রকৃত কারণ কি?
২/ সত্যিই কি সংস্কৃতি রক্ষার তাগিদে পৃথক রাজ্যের প্রয়োজন?
৩/এই আন্দোলনে রাজনৈতিক প্রভাব কতটা?
৪/ এটা কি সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলন নাকি রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির দাবি আদায়ের আন্দোলন?
কোচবিহার২৫°৫৭'৪০" এবং ২৬°৩২'৩০" উত্তর অক্ষাংশে অবস্থিত। এর পূর্ব দ্রাঘিমা ৮৮°৪৭'৪০" থেকে ৮৯°৫৪'৩৫".1 এটি পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি বিভাগের একটি জেলা। এর উত্তরে জলপাইগুড়ি জেলা, দক্ষিণে বাংলাদেশের রংপুর বিভাগ, পূর্বে আসামের ধুবড়ি জেলা এবং পশ্চিমে জলপাইগুড়ি জেলা ও বাংলাদেশের রংপুর বিভাগ অবস্থিত। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে কোচবিহার রাজ্য ব্রিটিশ ভারতের একটি করদ রাজ্যে পরিণত হয়। এই জেলায় কোনও পাহাড় বা পর্বত না থাকলেও একাধিক বিশাল আকার ঝিল দেখতে পাওয়া যায়। মোট আয়তন ১৮.১৯ বর্গ কিঃমিঃ বা ৩.১৬ বর্গমাইল। ভারতের ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এই জেলার মোট জনসংখ্যা ৭৭৯৩৫জন এর মধ্যে পুরুষ ৫১ শতাংশ এবং নারী ৪৯ শতাংশ সাক্ষরতার হার ৮২ শতাংশ পুরুষ সাক্ষরতার ৮৬ শতাংশ ও নারী সাক্ষরতা ৭৭ শতাংশ সারা ভারতের সাক্ষরতার হার ৫১.৫ শতাংশ।
নৃ-বিজ্ঞানী বুকানন হ্যামিল্টন, হডসন, ই.এ. গেইট প্রমুখের মতে “কোচেরা বৃহত্তর মঙ্গোলীয় নর গোষ্ঠীর বোডো শাখাভুক্ত একটি অন্যতম জাতি”। বহু সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে “কোচেরা মঙ্গোলীয় মহা গোষ্ঠীর তিব্বতীয় বর্মণ শাখা ভুক্ত অন্যতম জাত”। রেভারেন্ট এনঞ্জেলস এর মতে “বোডো, কোচ, মেছ, ধীমাল, ফুলগরিয়া, ডিমাসা, লালুং, গাড়ো, হাজং, জন-জাতিরা বৃহত্তর আদি কাছারী জাতির বংশধর। গ্রীক পরিব্রাজক টলেমি খ্রীষ্ট জন্মের দ্বিতীয় দশকে প্রাগ-জ্যোতিষপুর (কামরূপ) অঞ্চলে বোডো, কোচ, গাড়ো হাজং, মেছ, ডিমাসা, লালুং, রাভা, কাছারী- এই রূপ ৯টি জন-জাতির বসবাসের কথা উল্লেখ করেছেন। এ সমস্ত নৃ-বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন তথ্য ও তত্ত্বের ভিত্তিতে যথার্থভাবে বলা যায়, আসামের বৃহত্তর বোডো ভাষাভাষীর বংশাতিবংশের শাখা-প্রশাখার পৃথক পৃথক কোম বা জল বা Tribe হচ্ছে কোচ, কাছারী, মেছ, মান্দাই, বর্মন, রাজবংশী গাড়ো, হাজং ইত্যাদি জাতি গোষ্ঠীর লোকেরা। কোচেরা মঙ্গোলীয়, বোডো, কিংবা তিব্বতীয় বর্মন শাখাভুক্ত যাই হোক না কেন, তারা যে এই উপমহাদেশের প্রাচীনতম ইতিহাস সমৃদ্ধ জাত ও জাতি তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কোচ কোনো নির্দিষ্ট কোম বা Tribe -এর নাম নয়। অনেকগুলো কোমের সমষ্টির নাম নৃ-তত্ত্বের ভাষায় সমামেল বা confederacy of Tribes.
কোচরা হল ইন্দ মঙ্গলয়েড। সুদূর তিব্বত থেকে এদের আগমন, তিব্বত হল কোচ এবং মেচ দের আসল উৎপত্তি স্থল। অনেক তাত্ত্বিকরা অবশ্য মনে করেন কোচরাই হল বর্তমানের রাজবংশী। বেশ কিছু ঐতিহাসিক আবার মনে করেন কোচ জাতিই আসামে কোচ রাজবংশী নাম নিয়ে এবং পশ্চিমবঙ্গে এরাই রাজবংশী নাম নিয়ে অবস্থান করে চলেছেন। জ্যোতির্ময় রায়ের 'রাজবংশী সমাজ দর্পণ' বইটিতে লেখা রয়েছে এই জনগোষ্ঠী আসামে কোচ রাজবংশী হিসেবে পরিচিত হলেও উত্তরবঙ্গ তথা বিহার, ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশ এ কোচ, ভুটান ও নেপালে ক্ষত্রিয় রাজবংশীর হিসেবেই পরিচিত।
১৭৭৩ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে একটি চুক্তির মাধ্যমে রাজ্যটি কোচবিহার নামে পরিচিত হয় এবং এর রাজধানীর নাম হয় বিহার ফোর্ট উল্লেখ্য কোচবিহার শব্দটির অর্থ কোচ জাতির বাসস্থান কোচবিহার গেজেট অনুযায়ী মহারাজার আদেশ অনুযায়ী রাজ্যের সর্বশেষ নামকরণ হয় কোচবিহার।6 ১৯৪৯ সালের ২৮ শে আগস্ট রাজা জগদ্দিপেন্দ্র নারায়ন কোচবিহার রাজ্য কে ভারতীয় অধি রাজ্যের হাতে তুলে দেন এই বছর ১২ সেপ্টেম্বর থেকে কোচবিহার ভারতের কমিশনার শাসিত প্রদেশে পরিণত হয় ১৯৫০ সালের ১লা জানুয়ারি। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ২৯০ক ধারা বলে কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি জেলায় পরিণত হয়।6 ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে জেলার মোট জনসংখ্যার ৯৮.১১% জন বাংলা ভাষায় কথা বলেছেন, ১.৩৮% হিন্দি এবং ০.৫% মানুষ অন্যান্য ভাষায় কথা বলেন।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সমষ্টিতে শুধুমাত্র যে বাংলা দুটি আলাদা দেশে রূপান্তরিত হয়েছিল তাই নয় সেই সময়ে বাংলাদেশ থেকে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান থেকে অগণিত মানুষ ভারতে আশ্রয় নিতে আসেন। বাংলাদেশে সেই সময়ে হিন্দুদের ওপর মুসলমানদের অত্যাচার চলতো, মুসলিম পুরুষদের দ্বারা হিন্দু বাঙালি রমণীরা ধর্ষিতা হত, ছোট ছোট শিশুদের জীবন শেষ করে কুয়োয় ফেলে দেওয়া হতো, হিন্দুদের মেরে ফেলার, অত্যাচার করার, বাংলাদেশ থেকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেবার নেশা তখন কিছু মুসলিম মানুষদের মাথায় চড়ে বসেছিল। হিন্দু পরিবারগুলি তখন মুসলিমদের মত পোশাক পরে, মহিলারা বোরখা পরে মুসলিম সেজে এদেশে এসেছিলেন। উদ্বাস্তুদের মধ্যে অনেকেরই অর্থ ছিল। সেই অর্থ দিয়ে তারা স্থানীয় রাজবংশীদের কাছ থেকে প্রচুর জমি কেনেন এবং বসবাস করতে শুরু করেন।
বাংলা বিভক্তির ফলে রংপুর সহ আরও বিভিন্ন জায়গায় যেখানে রাজবংশীরা ব্যাপক হারে বসবাস করত সেই জায়গাগুলি বর্তমান বাংলাদেশের সীমানায় অন্তর্গত হয়ে পড়ে। সেখানকার হিন্দু - রাজবংশীরাও অন্যান্য হিন্দুদের সাথে মিলিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহার, ওড়িশা, আন্দামান সহ আরো বেশ কিছু জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করতে শুরু করেছিলেন। এই দোলাচলের মধ্যে প্রথমে করদমিত্র এবং পরে কেন্দ্রশাসিত কোচবিহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্তি পশ্চিমবঙ্গের সাথে হয়ে যায়।
স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে সংগঠিত বিভিন্ন আঞ্চলিক আন্দোলন ছিল একটি সাধারণ বিষয় এই সময় ভারতবর্ষের পৃথক পৃথক ভাষাভাষী সংস্কৃতির মানুষ তাদের নিজেদের সামাজিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শ সমাজে প্রতিস্থাপিত করার জন্য বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠন তৈরির মাধ্যমে আঞ্চলিক আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন।9 এর পরপরই লক্ষ করা যায় উদ্বাস্তুদের আগমনের ফলে রাজবংশী সমাজের মধ্যে এবং আসামের কোচ রাজবংশী সমাজের মধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব ভাষা সংস্কৃতি রক্ষার দাবিতে বিভিন্ন সামাজিক দল গঠন করেন এবং সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে নেমে পড়েন এই সমস্ত সংগঠন গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশন। যে সংগঠনের মাধ্যমে গ্রেটার কোচবিহার আন্দোলনটি পরিচালিত হয় এই সংগঠনগুলিকে শুধুমাত্র সামাজিক আন্দোলন বললে ভুল হবে বরং এদের আন্দোলন গুলিকে সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলন বলা যেতে পারে কারণ রাজনৈতিক ইস্যু প্রত্যেকটি দলই বর্তমান।
বিভিন্ন রাষ্ট্রচিন্তাবিদ এর মতে কোচ রাজবংশী জাতির দীর্ঘদিনের গ্রেটার কোচবিহার আন্দোলন সমাজের মূল স্রোতের রাজনীতি থেকে তাদের খানিকটা দূরে সরিয়ে রেখেছে | কোচ রাজবংশী জনসাধারণ নিজেদের ভাষা সংস্কৃতি ঐতিহ্য রক্ষার দাবিতে এবং একটি পৃথক কোচবিহার রাজ্যের দাবিতে বিশাল সংখ্যক রাজবংশী মানুষ কে যুক্ত করেছে।
গ্রেটার কোচবিহার আন্দোলনের নেতা অনন্ত রায় (মহারাজ) এর সাক্ষাৎকার অনুযায়ী - ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ২৮ শে আগস্ট ভারতবর্ষের সাথে দেশীয় স্বাধীন কোচবিহার রাজ্য চুক্তি ভিত্তিক ভাবে অংশগ্রহণ করে ভারতের অঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন কোচবিহার স্বতন্ত্র রাজ্যের মহারাজা শ্রী জগদ্দিপেন্দ্র নারায়ন বাহাদুর এবং ভারতবর্ষের হয়ে স্বাক্ষর করেছিলেন ভি পি মেনন। এই চুক্তির ভিত্তিতে ২৮ শে আগস্ট কোচবিহার নামক দেশীয় রাজ্যকে ভারতবর্ষে শামিল করে নেওয়া হয় এবং ভারতীয় সংবিধানে কোচবিহার কে "গ"শ্রেণির রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হলোও পরবর্তীতে অসাংবিধানিকভাবে রাজ্যটিকে দুটি অংশে বিভক্ত করে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের সাথে যুক্ত করে দেওয়া হয়। যার ফলস্বরূপ এখানকার আদি অধিবাসীরা আত্মমর্যাদা হারায়। ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম মহাশয় এর কাছে কোচবিহার বাসীর পক্ষ থেকে বিষয়টি অবগত করানো হয় এবং একটি আবেদনপত্র সমেত স্মারকলিপি পাঠানো হয়, যা রাষ্ট্রপতি মহোদয় কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল। তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের সচিব এস. পাল বলেন ভারতবর্ষের গৃহ মন্ত্রী পৃথক কোচবিহার রাজ্য গঠনের বিষয়ে যা সিদ্ধান্ত নেবে তা পশ্চিমবঙ্গ সরকার সর্বতোভাবে মেনে নিতে বাধ্য থাকবেন। কিন্তু বহুদিন যাবত এই সম্পর্কিত কোনো কার্যকলাপ এগোয়নি। ভারতের অন্তর্ভুক্তির পর কোচবিহারের মহারাজা জগদ্দিপেন্দ্র নারায়ন ভারত সরকারকে গ্রেটার কোচবিহার স্টেট গঠনের জন্য আবেদন করেছিলেন যার ফলে একটি এক্সপার্ট কমিটিও গঠন করা হয়েছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আজ পর্যন্ত তার কোনো কাজ সম্পন্ন হয়নি। গ্রেটার অবিভক্ত কোচবিহার রাজ্যের সীমানা পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার এবং অসমের চারটি জেলা- ধুবড়ি, বঙ্গাইগাঁও, কোকরাঝাড় ও অবিভক্ত গোয়ালপাড়া জেলা নিয়ে গঠন করার কথা বলা হয়।
কোচবিহার ছিল পূর্বে একটি সমৃদ্ধ দেশীয় রাজ্য। যে রাজ্যে ভারত বর্ষ তথা ইউরোপীয় বণিক সংস্থা কাজের সূত্রে ও জীবিকা নির্বাহের জন্য আসতেন কিন্তু বর্তমানে কোচবিহারের আর্থসামাজিক অবস্থা এ চরম অবনতি ঘটেচলেছে। এখানকার জনমানষে নেমে এসেছে অন্ধকারাচ্ছন্ন সংস্কৃতিক বিপর্যয়। কাজের সূত্রে এখানকার সেই সমস্ত আদি অধিবাসীগণ দিনমজুরি করতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে তারা কাজের সন্ধানে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন শুধুমাত্র কর্মসংস্থানের জন্য। কারণ বর্তমানে এই কোচবিহার রাজ্য টি পিছিয়ে পড়া একটি রাজ্যের মধ্যে গণ্য করা হয়। তাদের বা কোচ রাজবংশী জাতির নিজস্ব কোচ - সংস্কৃতি দিনের পর দিন বাঙ্গালীদের সাথে মিশে তাদের নিজস্বতা হারিয়ে ফেলছে। যার দরুন তারা আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছেন, ভিটেমাটি ছাড়া হচ্ছেন, যদি পৃথক কোচবিহার রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় তবে তাদের দাবিগুলো হলো কোচবিহারের সামাজিক, আর্থিক, আর্থসামাজিক, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও সর্বোপরি রাজনৈতিক বিকাশ সাধন করা সম্ভবপর হয়ে উঠবে। তাই এই উন্নয়নের জন্য কোচবিহারে গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের তরফ থেকে আন্দোলনের সূচনা করা হয়েছে, পৃথক কোচবিহার রাজ্য গঠনের দাবিতে।
এই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী উল্লেখযোগ্য নেতাগণ হলেন - অনন্ত রায় (মহারাজ), বংশী বদন বর্মন, পরেশ বর্মন, সুজয় সিংহ, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, করণদিঘি ব্লক উত্তর দিনাজপুর। উত্তর দিনাজপুর জেলার সভাপতি সুদেব সিংহ, কুমুদ দাস (করনদিঘি), জি সি পি এ -এর সাধারণ সম্পাদক নমিতা বর্মণ প্রমুখ।
গ্রেটার কোচবিহার নামের আলাদা রাজ্যের দাবি প্রথম ওঠে ১৯৯৭-৯৮ সালে ১৯৯৮ সালে পৃথক রাজ্যের দাবিতে তৈরি হয় গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশন নামক একটি রাজনৈতিক সংগঠন। 11 এর পরবর্তী থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে পৃথক রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন সূচিত হয়। ২০০৫ সালে এই গ্রেটার কোচবিহার আন্দোলনকারীদের অবরোধের সময় ব্যাপক হিংসা দেখা দেয় তিনজন পুলিশ অফিসার সহ ৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল এই অবরোধে। এদের মধ্যে এক আইপিএস অফিসার সহ তিন পুলিশকর্মী এবং দুইজন আন্দোলনকারী এর ও মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পরবর্তী তে সেটি একটি রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করতে সাহায্য করেছিল। ২১ ও ২২ সেপ্টেম্বর গ্রেটার নেতা বংশী বদন বর্মন সহ ৪৭ জনের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করা হয়। ২৫ শে সেপ্টেম্বর আদালতে বংশী বদন বর্মন আত্মসমর্পণ করেন।
প্রায় ৪০০ বছর আগে কোচবিহার রাজাদের যে রাজত্ব ছিল, দ্বিতীয় কোচ রাজা নর নারায়ণের আমলে জলপাইগুড়ি জেলার করতোয়া নদীর ধার থেকে বর্তমানে আসাম রাজ্যের গোয়াহাটি পর্যন্ত সেই এলাকাকেই গ্রেটার কোচবিহার নাম দিয়ে নতুন পৃথক রাজ্যের দাবি জানানো হয়। কোচবিহার রাজবংশের যে সাবেক প্রজারা, যারা মূলত রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ তারাই এই দাবি তুলেছেন।10 ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর ৬ ডিসেম্বর গ্রেটার নেতা বংশী বদন বর্মনকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয় তবে এর মধ্যেই দুজন নেতার মৃত্যু হয়েছিল। জামিনের পরে আরো দুজন নেতার মৃত্যু হয়। এদিন বংশী বদন সহ ৪৩ জন কর্মীকে বেকসুর খালাস দান করা হয়।11
গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশন (জি সি পি এ) এর ডাকে ১৮ ই জুলাই ২০১১ থেকে আমরণ অনশনের কর্মসূচি শুরু করেছিল গ্রেটার সমর্থক গণ। ১৮ ই জুলাই কোচবিহার রাসমেলা ময়দানে অনশন শুরু হলেও ১৯ জুলাই মঙ্গলবার কোচবিহার জেলা শাসকের হস্তক্ষেপে অনশন মঞ্চকে সরিয়ে এম.জে.এন স্টেডিয়াম এবং রাজবাড়ির পেছনে জনমানব শূন্য পরিত্যক্ত জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। জি সি পি এ এর সাধারণ সম্পাদক নমিতা বর্মন এর মত অনুযায়ী তাদের এই অনুষ্ঠানের মূল তিনটি দাবি ছিল। এক, তদানীন্তন কোচবিহার রাষ্ট্র ও ভারত রাষ্ট্রের মধ্যে যে চুক্তি মারফত কোচবিহার রাষ্ট্রকে ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল সেই চুক্তির বাস্তবায়ন। দুই, কোচবিহার কে 'গ' শ্রেণীভূক্ত রাজ্যে রূপান্তর। তিন, অবিলম্বে জিসিপিএ সংগঠনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক মন্ত্রিসভা গঠন। এই তিনটি দাবির ভিত্তিতে দিল্লির যন্তর মন্তর এর সামনেও জিসিপিএ এর সভাপতি এবং সহকর্মীরা অনশন আন্দোলন চালিয়ে ছিলেন। প্রায় ৫০ হাজার মানুষ এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন প্রথমদিকে অনশন মঞ্চে হাজার দশেক এবং তারপর হাজার দুয়েক মানুষ ছিলেন। কিছু লোক প্রথম থেকে ছিলেন এবং বাকিরা পরে এখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আন্দোলন করায় সমর্থকগণ-এর একটি বড় অংশ অসুস্থ হয়ে স্থানীয় এম জে এন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এবং নিজেদের উদ্যোগে চিকিৎসা গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। উপস্থিত অনশনকারীদের মধ্যে উত্তরবঙ্গের পাঁচটি জেলা যথা- কোচবিহার, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, উত্তর দিনাজপুর ও দক্ষিণ দিনাজপুর এবং আসামের চারটি জেলা- ধুবড়ি, কোকড়ঝার ও গোয়ালপাড়ার বসবাসকারী বহু মানুষ উপস্থিত ছিলেন। এদের মধ্যে নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সহ হাঁপানির অসুস্থতা নিয়ে ষাটোর্ধ্ব ধীরেন বর্মন নামক জনৈক ব্যক্তি ও উপস্থিত ছিলেন। ২৮ শে জুলাই উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ার সোনার পুরের বাসিন্দা সপ্না সিংহ অনশন তাঁবুতেই পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। 12
এই সময়ে ভারী বর্ষণের ফলে অনশন স্থল পুরোপুরি জলকাদায় ভরে গিয়েছিল যার ফলে মানুষের থাকার অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। আন্দোলনকারীরা বাধ্য হয়ে ছোট ছোট ত্রিকোণাকার পলিথিন এর তাবু বাঁশ দিয়ে টাঙিয়ে এবং নিচে প্লাস্টিক এর পলিথিন পেতে গাদাগাদি করে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। আন্দোলন কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই মানুষ জন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দীর্ঘদিন যাবত অংশগ্রহণ করেছিলেন। অনশনরত মানুষের মধ্যে প্রায় সকলেই ছিলেন সমাজের ও নিদারুণ আর্থিক কষ্টে ভোগা অতি সাধারণ মানুষ। আন্দোলনকারীদের অত্যন্ত ক্ষোভ ছিল যে একাধিক দৈনিক পত্রিকা অনশন আন্দোলনের সংবাদ বিকৃতভাবে পরিবেশন করেছিল বলে। তবে শেষ পর্যন্ত শর্ত সাপেক্ষ অনশন আন্দোলন তুলে নিতে রাজি হয়েছিল জিসিপিএ। ৩০ জুলাই শনিবার কোকড়ঝাড় এর জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের সাথে আলোচনায় জিসিপিএ শর্ত দিয়েছিল যে দিল্লিতে যন্তর-মন্তর এর সামনে আন্দোলনরত সভাপতির সাথে ১লা আগস্ট এর মধ্যে কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের প্রতিনিধিকে আলোচনায় বসতে হবে। এই শর্তে সহমত পোষণ করায় জিসিপিএ কোচবিহারের অনশন আন্দোলন সেই যাত্রায় প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। 12
গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে পৃথক রাজ্যের দাবিতে তিন লক্ষেরও বেশি সমর্থক একসঙ্গে অনশন শুরু করেন। পাঁচ দিন ধরে টানা অনশন চলার পর, চাপে পড়ে তৎকালীন বাম সরকার। পুলিশ জোর করে অনশন তুলতে গেলে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে যায়। তাতে ৫ জনের মৃত্যু হয়। ফলস্বরূপ সরকার সমালোচনার মুখে পড়ে এবং আন্দোলন প্রশমিত করার উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বেশ কয়েকজন গ্রেটার নেতা কে গ্রেপ্তার করা হয়।
তেলেঙ্গানা নামক নবগঠিত রাজ্য এর জন্ম হওয়ার পর নতুন করে গ্রেটার কোচবিহারের দাবি সামনে আসে। এই আন্দোলনের অন্যতম নেতা বংশী বদন বর্মন বলেন যদি তেলেঙ্গানা স্বীকৃতি পেতে পারে তবে গ্রেটার কোচবিহার কেন নয়? তার ধারণা কোচবিহার কে বেআইনিভাবে জেলার মর্যাদা দিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি নতুন করে গ্রেটার কোচবিহার আন্দোলন সংগঠিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। বর্তমানের কোচবিহার জেলা এক সময় বৃহত্তর কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। ১৭৭২ সালে কোচবিহার রাজ্য টি ব্রিটিশ ভারতের একটি করদ রাজ্যে পরিণত হয়েছিল যা পরবর্তীতে ১৯৫০ সালে পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলায় পরিণত হয়। গ্রেটার কোচবিহার আন্দোলনের নেতা বংশী বদন বর্মনের বক্তব্য "আমরা বাঙালি নই, কোচ রাজ্যের মানুষ" সেই ভাবনা থেকেই দানা বাঁধে গ্রেটার কোচবিহার আন্দোলন।13
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরবঙ্গ সফরের ফলে নতুন করে নাড়া দিয়ে উঠেছিল গ্রেটার কোচবিহার রাজ্য গঠনের জোরালো দাবি। দীর্ঘদিন পরে এই দাবীতে পথে নেমেছিলেন বহু সমর্থক। নেতৃত্বে ছিলেন সেই বংশী বদন বর্মা, যিনি পুলিশকর্মীকে খুনের অভিযোগে বাম আমলে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। নতুন সরকার আসার পর মুখ্যমন্ত্রী রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার যে উদ্যোগ গ্রহণ করে ছিলেন, তাতে সাড়া পান বংশী বদন। পরে খুনের মামলায় আদালতে বেকসুর খালাস পান তিনি। তার পায়ের তলায় জনসমর্থনের ভিত যে এখনও যথেষ্ট শক্ত তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল এই আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণ দেখে। কোচবিহারে জেলাশাসকের দপ্তরের সামনে এই সমাবেশে ভিড় হয়েছিল ভালোই। জনগণের একনিষ্ঠ অংশগ্রহণের ফলে প্রায় দুই ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। জেলাশাসকের দপ্তরের সামনের ব্যস্ততম রাস্তা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করেছিলেন, যা ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রশাসনিক আশ্বাসের ফলে অবরোধ উঠিয়ে নেওয়া হলেও গ্রেটার কোচবিহারের দাবিদাররা ভবিষ্যতে তাদের দাবি না মানলে বড় ধরনের আন্দোলনের বার্তাও দিয়ে গিয়েছিলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে একটি প্রশ্ন উঠে আসে যে গ্রেটার সমর্থকগণ পরিকল্পনা করে পুলিশ ও প্রশাসনকে ব্যস্ত করে রেখেছিল কিনা? এই প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বংশী বদন বলেন - "মুখ্যমন্ত্রী উত্তরবঙ্গে থাকুন আর যেখানেই থাকুন, আমাদের তাতে কিছু যায় আসে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, কোচবিহার সেই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত নয়। আলাদা রাজ্যের দাবি জানাতে খুব শিগগিরই আমরা দিল্লি যাবো'। এই বক্তব্যের সারমর্ম হল গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের সমর্থকগণ কোচবিহার জেলাকে আলাদা রাজ্য বলেই মনে করতো। 14
নির্বাচনের পূর্বে গ্রেটার নেতা বংশী বদন তৃণমূল কংগ্রেসকে সমর্থন করলেও পরে তাদের আশাহত হয়, তার কারণ স্বরূপ নতুন করে আন্দোলনে নামে গ্রেটার নেতৃত্ব। তবে তাদের এই আন্দোলনকে ফরওয়ার্ড ব্লক বিধায়ক উদয়ন গুহ, সিপিএম এর কোচবিহার জেলা সম্পাদক তারিণী রায়, কোচবিহার তৃণমূল নেতৃত্ব কেওই সমর্থন করেননি। এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ কোচবিহারের জেলা তৃণমূল সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলেছিলেন "মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে রাজ্যের সর্বোচ্চ উন্নয়নে কর্মযজ্ঞ চলছে এই সময়ে কোন হিংসাত্মক আন্দোলন কে প্রশ্রয় দেওয়া হবেনা। ২০০৫ এর গ্রেটার কোচবিহার আন্দোলন এ তিনজন পুলিশ কর্মীসহ ৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল, তারপর দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় ছিল এই সংগঠনটি যা পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। 14
২০১৬ সালে পুনরায় আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। তারা পৃথক গ্রেটার কোচবিহার রাজ্যের দাবিতে পশ্চিমবঙ্গের নিউ কোচবিহার স্টেশন এ চার দিন ধরে অবরোধ চালিয়ে ছিলেন, ট্রেনের ভেতরে আটক অবস্থায় অসুস্থ হয়ে দুজন যাত্রীর মৃত্যুবরণ এর ঘটনার পরই মঙ্গলবার পুলিশ অপারেশন শুরু করেছিলেন। এই সময়ে পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে এক খন্ডযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে। পুলিশ লাঠিচার্জ করে হাজার তিনেক আন্দোলনকারীকে রেললাইন থেকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিলেন সমস্ত স্তরের সাধারণ কোচ-রাজবংশী জনগণ, কৃষক-শ্রমিক, সাধারণ গৃহবধু, বর্ষীয়ান নাগরিক সমর্থক প্রমুখ ব্যক্তি। অগণিত আন্দোলনকারী ও পুলিশ আহত হয়েছিল, মাথা ফেটে ছিল অনেক মানুষের। সরকারের কাছ থেকে আশ্বাস পাওয়ার পর শেষ পর্যন্ত গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের নেতা বংশী বদন বর্মন তাদের কর্মসূচি স্থগিত করেছিলেন।
২০১৭ সালে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে গ্রেটার কোচবিহারের নেতাগণ পুনরায় তাদের আন্দোলন কে জনসমক্ষে তুলে ধরেন। তাদের দাবি গোর্খাল্যান্ডের দাবিদারদের সঙ্গে বারবার সরকার আলোচনায় বসলেও কেন গ্রেটার কোচবিহারের সঙ্গে নয় সে প্রশ্ন তুলে রাস্তায় নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন বংশী বদন বর্মন। কোচবিহার প্রেসক্লাবে সাংবাদিক বৈঠক করে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন গোর্খাল্যান্ডের দাবিদাররা বাইরে থেকে এসেছেন বলে শোনা যায়। সে ক্ষেত্রে তাদের জিটিএ দেয়া হল। সরকার তাঁদের ঘনঘন আলোচনায় ডাকছেন কেন? তিনি বলেছিলেন "আমরা কোচবিহারের ভারতভুক্তি চুক্তি রূপায়নের দাবি তুলেছি। সেই দাবিকে কেও গুরুত্ব দিচ্ছে না। স্পষ্ট করে কেও আমাদের পরিচয় জানাচ্ছেন না। কিভাবে কোচবিহার রাজ্য থেকে জেলা হল? তা নিয়ে কারও মুখে কোন শব্দ নেই। অথচ গোর্খাল্যান্ড নিয়ে ঘন ঘন আলোচনা হচ্ছে।" তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে ছিলেন কোচবিহারের বাসিন্দাদের সঙ্গে এমন অন্যায় মেনে নেওয়া হবে না। দীর্ঘদিন পরে রাজ্যের দাবি নিয়ে আবার রাস্তায় নামার হুঁশিয়ারি দিয়ে ছিলেন বংশী বাবু। ২৮ শে আগস্ট গোসানিমারি রাজপাট থেকে কোচবিহার সাগরদিঘী পারে বীর চিলা রায়ের মূর্তির পাদদেশ পর্যন্ত পদযাত্রা করেছিলেন। চিলা রায় ছিলেন কোচবিহারের শ্রেষ্ঠ বীর সৈনিক। সেই দিন জেলাশাসক কে একটি স্মারকলিপিও দেওয়া হয়েছিল এবং সেই আন্দোলনের পুলিশ প্রশাসন সতর্ক নজরদারি শুরু করেছিলেন। বংশী বাবু জানিয়ে ছিলেন আন্দোলনের নামে হিংসা তারা পছন্দ করেন না। তিনি বলেছিলেন "পাহাড়ে যে হিংসা চলছে তা কেউ সমর্থন করে না। আমরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করবো। 15
২০২০ সালে এন আর সি এর পক্ষে এবং সি এ এ এর বিরোধিতায় কোচবিহার দিনহাটা এর রাসমেলা মাঠে ভূমিপুত্র ঐক্য মঞ্চের সমাবেশে গ্রেটার নেতৃত্তের অংশগ্রহণ লক্ষ করা যায়। কোচবিহার রাসমেলা মাঠে কে পি পি এর যৌথ ভূমিপুত্র ঐক্য মঞ্চ এন আর সি এর সমর্থন ও সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এর বিরোধিতায় প্রকাশ্য সমাবেশের ডাক দিয়েছিল। কোচবিহার রাজ্যের ভারতভুক্তি চুক্তি কার্যকর করার দাবিতে সম্প্রতি এই দুই সংগঠন জোট বদ্ধ হয়েছিল। ওই আন্দোলনে অন্যান্য সংগঠন কেও একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন গ্রেটার নেতা বংশী বদন বর্মন। সভা থেকেই বংশী বদন তার বিরোধী গোষ্ঠীর নেতা অনন্ত রায় কে ভূমিপুত্র ঐক্য মঞ্চের ব্যানারে কোচবিহার বাসির জন্য আন্দোলন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। লক্ষাধিক লোকের জমায়েতের লক্ষ্য নিয়ে দিনভর গ্রেটার প্রচার করে। বংশী বদন বর্মন জানিয়েছিলেন সভামঞ্চে দলীয় কর্মী সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বড় কিছু ঘোষণা করবেন। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে কোচবিহার রাজ্যের ভারত ভুক্তির দাবিতে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান বংশী বদন বর্মন ও কামতাপুর প্রগ্রেসিভ পার্টির প্রধান পুনরায় একত্রিত হয়ে ভূমিপুত্র ঐক্য মঞ্চ তৈরি করেছিলেন। ওই ঐক্য মঞ্চের ব্যানারে আলাদা রাজ্য সহ কোচবিহার রাজ্যের ভারতভুক্তি চুক্তি রূপায়নের দাবিতে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন গ্রেটার ও কে পি পি। গ্রেটার নেতা ও ভূমিপুত্র ঐক্য মঞ্চের চেয়ারম্যান বংশী বদন বলেন "আমাদের আন্দোলন জাতি মাটির জন্য আন্দোলন, আমরা সবাই এক মঞ্চে একসঙ্গে আন্দোলন করলে মন্দ কি? সবার জন্য দরজা খোলা রয়েছে। যে কেউ আসতে পারেন, সবাইকে সম্মান করা হবে। নিজেদের মধ্যে কোন ভুল-বোঝাবুঝি থাকলে তাও মিটে যাবে।" 16
একটি রাজ্যে বসবাসকারী প্রধান ভাষা গোষ্ঠীই সেই রাজ্যের অধিকারী, ওই ভাষায় যারা কথা বলেন তারাই হলেন ওই রাজ্যের ভূমিপুত্র বা স্থানীয় বাসিন্দা। বাকিরা সকলে বহিরাগত।17 আলাদা রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন করা গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশন ও কামতাপুর প্রগ্রেসিভ পার্টির দুই সুপ্রিমো বংশী বদন বর্মন ও অতুল রায়ের নেতৃত্বে তাদের আন্দোলন কে জোরদার করতে ২০১৯ সালে ভূমিপুত্র ঐক্য মঞ্চ নামে যৌথ সংগঠন গড়ে দাবি আদায়ের আন্দোলনে তারা নেমেছিলেন। উত্তরবঙ্গের জেলায় জেলায় এন আর সি -এর দাবিতে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল এই ঐক্য মঞ্চ। রাজনৈতিক মহলের ধারণা ছিল বিধানসভা নির্বাচনের আগে এন আর সি চালুর দাবিতে ১৬ ই জানুয়ারি কোচবিহারের রাসমেলা মাঠে প্রকাশ্য সভা করে নিজেদের জনসমর্থন প্রদর্শন করতে চেয়ে ছিলেন জি সি পি এ এবং কে পি পি এর যৌথ মঞ্চ। এন আর সি কে সমর্থন করে তারা বিজেপির ভোট একদিকে যেমন নিজেদের দিকে আনতে চেয়েছিলেন অন্যদিকে সি এ এ -এর বিরোধিতা করে বিজেপি বিরোধী জোটকেও নিজেদের দিকে টানার রণকৌশল গ্রহণ করেছিলেন। এই প্রকাশ্য সমাবেশকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য তাঁরা কয়দিন ব্যাপী জোরদার প্রচার করেছিলেন। যার ফলে কোচবিহার জেলার পাশাপাশি আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, এমনকি শিলিগুড়ি থেকেও অনেক সমর্থক এই সভায় যোগ দিয়েছিলেন। 16
২০০৫, ২০১১, ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭, ২০২০ এবং ২০২১ সমস্ত স্তরেই দেখা যায় যে কোনো না কোনো রাজনৈতিক অবস্থার সূত্র ধরেই এই আন্দোলন বারংবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাই এই যুক্তির উপর ভিত্তি করেই গ্রেটার কোচবিহার আন্দোলনের চরিত্র বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, এই আন্দোলন ছিল সামাজ-সাংস্কৃতি রক্ষা তথা সর্বোপরি রাজনৈতিক প্রভাব এর দ্বারা পরিচালিত। যার মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাব চরম পর্যায়ে পরিলক্ষিত হয়। আন্দোলনকারীরা একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে( উত্তরবঙ্গের মালদহ, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং এবং আসামের অবিভক্ত গোয়ালপাড়া জেলা) দাবি করলেও এই আন্দোলন মূলত কোচবিহার কেন্দ্রিক সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। মহারাজ অনন্ত রায় দীর্ঘ সময় ধরে আসামে অবস্থান করায় আন্দোলনের গতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এছাড়াও গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের দুজন প্রধান প্রথম সারির নেতা অনন্ত রায় ও বংশী বদন বর্মনের মতপার্থক্যের ফলে তাদের সমর্থক দের মধ্যে দুটি গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে, যা আন্দোলনের গতি কে দুর্বল করে দিয়েছে। দারিদ্রতা, কর্মসংস্থানের অভাব, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হওয়ার কারণে এ আন্দোলন কোচ- রাজবংশী সমাজে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। রাজ্য সরকার পরিচালিত রেডিওতে কামতাপুরী ভাষা ও সংস্কৃতির প্রচার এর দাবি তোলা হয়।
মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের অধীনে ছিল এই নারায়নী সেনা। কুরুক্ষেত্রে তারা যুদ্ধ করেছিলেন কৌরব দের পক্ষে। নিজস্ব সেনাদলকে এই নাম দেন কোচবিহারের রাজা নরনারায়ন। তার ভাই চিলা রায় ছিলেন সেনাপতি। এই একই নামে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশন (জি সি পি এ)। এই সেনার প্রধান অনন্ত মহারাজ এর দাবি নবনী অসম ও উত্তরবঙ্গ মিলিয়ে তাদের সদস্য সংখ্যা ৬০ হাজার। সেনাবাহিনীতে রেজিমেন্ট তৈরি হবে এই সম্ভাবনা চাউল হতেই ২০০ টাকা দিয়ে নাম লেখানো শুরু হয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৯ সালের ২৮ শে আগস্ট ভারতভুক্তির সময় কুচবিহারের রাজা জগদ্দিপেন্দ্র এর সঙ্গে ভি পি মেনন এর যে চুক্তি হয়েছিল সেখানে কোচ সেনাদের ভারতীয় বাহিনীতে নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। সেই রেজিমেন্টের নামের সঙ্গে নারায়নী শব্দটি যুক্ত থাকবে বলেও তখন বলা হয়েছিল, তবে কার্যক্ষেত্রে সেই চুক্তি মানা হয়নি।
(বি. দ্র.- লেখায় কোন ভুল ত্রুটি থাকলে মার্জনা করবেন)
Post a Comment