মুঘল যুগ:  বাবর থেকে আকবর




সুলতানি যুগের পতন: 

সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের ক্ষেত্রে যে সমস্ত কারণগুলি উল্লেখযোগ্য ছিল সেগুলি হল- 

  1. আফগানদের অন্তর্ষ্য ও স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা, 

  2. আর্থিক দুর্বলতা, 

  3. জনসমর্থনের অভাব, 

  4. ধর্মীয় সমস্যা, 

  5. সামরিক দুর্বলতা এবং 

  6. বৈদেশিক আক্রমণ। 


1398 খ্রি. তৈমুর লঙের ভারত আক্রমণ দিল্লিকে শ্মশানে পরিণত করে। তাঁর পরবর্তীতে 1526 খ্রি. বাবর ভারত আক্রমণ করেন যার ফলস্বরূপ সুলতানি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে ও মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা হয়।




 বাবর: 


  • তিনি 1483 খ্রি. ফরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ওমর শেখ মির্জা ছিলেন তৈমুর লঙের বংশধর এবং মাতা কুতলুঘ নিগার খানুম ছিলেন চেঙ্গিজ খাঁর বংশধর। 

  • বাবরের প্রকৃত নাম ছিল জাহিরউদ্দিন মহম্মদ বাবর। 

  • তিনি নিজ রাজ্য ফরগনা থেকে বিতাড়িত হয়ে প্রথমে কাবুল অধিকার করেন ও তারপর ভারতে রাজ্যবিস্তারের জন্য অগ্রসর হন। 

  • তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম হল- তুজুক-ই-বাবরি।




 মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা: 

  • ইব্রাহিম লোদির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য পাঞ্জাবের সুবাদার দৌলত খাঁ লোদি, মেবারের রানা সঙ্গআলম খান (ইব্রাহিমের পিতৃব্য) বাবরকে আমন্ত্রণ জানান। 

  • 1526 খ্রি. পানিপথের প্রথম যুদ্ধে জয়লাভের দ্বারা বাবর লোদি বংশের উচ্ছেদ করে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। 


এরপর তিনি - 

  • 1527 খ্রি. খানুয়ার যুদ্ধে রানা সঙ্গ, 

  • 1528 খ্রি. চান্দেরীর যুদ্ধে মেদিনীরায় এবং 

  • 1529 খ্রি. ঘর্ঘরার যুদ্ধে মাহমুদ লোদিকে পরাজিত করে মুঘল সাম্রাজ্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। 

  • তিনিই প্রথম ভারতে কামান ও বন্দুকের ব্যবহার শুরু করেন।



স্থাপত্য: 

বাবরের সময় উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যকার্যগুলি ছিল-

লোদি দুর্গ (আগ্রা), 

কাবুলিবাগ মসজিদ (পানিপথ), 

জামি মসজিদ (রোহিলখণ্ড)।


মৃত্যু: 1530 খ্রি. তিনি মৃত্যুবরণ করেন।









হুমায়ুন: 

  • হুমায়ুন শব্দের অর্থ হল সৌভাগ্যবান। তাঁর পিতা ছিলেন বাবর ও মাতা ছিলেন মাহাম বেগম। 

  • তিনি 1530 খ্রি. মুঘল সিংহাসনে আরোহণ করেন। 

  • তিনি 1531 খ্রি. কালিঞ্জর অবরোধ করেন ও 1532 খ্রি. দৌরার যুদ্ধে মামুদ লোদিকে পরাজিত করেন। 

  • কিন্তু 1539 খ্রি. ও 1540 খ্রি. চৌসার ও বিল্বগ্রামের যুদ্ধে তিনি শেরশাহের কাছে পরাজিত হয়ে সিংহাসনচ্যুত হন। 

  • শেরশাহর মৃত্যুর পর তাঁর পরবর্তী শাসক সিকান্দার সুরিকে হুমায়ুন পরাজিত করে 1555 খ্রি. মুঘল সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। 

  • 1556 খ্রি. তাঁর মৃত্যু হয়। 

  • হুমায়ুনের আমলে ইরানের মীর সৈয়দ আলিআবদুস সামাদ নামক দুই চিত্রকরের ভারতবর্ষে আগমন ঘটে।








সুরিবংশ-শেরশাহ (1540-1545 খ্রি): 

  • ভারতবর্ষের মহান শাসকদের মধ্যে শেরশাহ ছিলেন অন্যতম। তিনি 1472 খ্রি. হোসিয়ারপুর জেলার ডাজওয়ারাতে জন্মগ্রহণ করেন। 

  • তাঁর প্রকৃত নাম ছিল ফরিদ খাঁ এবং তাঁর পিতা ছিলেন হাসান খান। 

  • 1529 খ্রি. তিনি বিহারের স্বাধীন শাসকে পরিণত হন। 

  • তিনি চৌসার (1539 খ্রি:) ও বিশ্বগ্রামের যুদ্ধে (1540) খ্রি.) মুঘল বাদশাহ হুমায়ূনকে পরাজিত করে দিল্লিতে সুরি বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। 

  • স্বল্প সময়ের শাসনকালে শেরশাহ শাসনসংস্কারের দিক থেকে অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দেন।



শাসনব্যবস্থা: 

  • শেরশাহ সমগ্র সাম্রাজ্যকে 47টি সরকারে বিভক্ত করেন। 

  • তাঁর সামরিক ও অসামরিক বাহিনীর প্রধান ছিলেন যথাক্রমে শিকদার-ই-শিকদারান ও মুনসেফ-ই-মুনসিয়ান। 

  • প্রতিটি সরকার বহুসংখ্যক পরগনায়, ও পরগনাগুলি গ্রামে বিভক্ত ছিল।

  • সুবা > সরকার > পরগনা > গ্রাম

 

বিচারব্যবস্থা: 

  • শেরশাহর আমলে বিচারব্যবস্থা ছিল কঠোরনিরপেক্ষ। 

  • সেই সময়ে বিচারব্যবস্থার প্রধান ছিলেন সম্রাট স্বয়ং। 

  • ফৌজদারি ও দেওয়ানি বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে নিযুক্ত শাসনকর্তারা ছিলেন কাজি উল কাজতান এবং মনুসিফ ই মুনসেফান।

  •  শেরশাহ ঘোড়ার গায়ের চিহ্নিতকরণ (দাগ) ও সৈনিকদের দৈহিক বিবরণ (হুলিয়া) আলাউদ্দিন খলজি-কে অনুসরণ করে লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থা করেন। 


 ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা: 


  • শেরশাহ ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কিত নতুন কিছু পদ্ধতির প্রচলন শুরু করেন। তিনিই প্রথম জমি জরিপ করার ব্যবস্থা শুরু করেন। 

  • উৎপাদিত শস্যের এক তৃতীয়াংশ (নগদ অর্থ বা শস্য) রাজস্ব হিসেবে সম্রাটকে দিতে হত।

  • তিনি প্রথম কবুলিয়ত ও পাট্টা ব্যবস্থার প্রচলন করেন। 

  • তাঁর আমলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যথা দুর্ভিক্ষ, অনাবৃষ্টি প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রজারা ঋণ গ্রহণ করার সুযোগ পেত। এই ধরনের ঋণ-কে 'তকভি’ ঋন বলা হত। 

  • সেই সময় জরিবানা ও মহাশিলানা  নামে করদান ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।




জনহিতকর কার্যাবলি: 


  • শেরশাহ কতগুলি রাজপথ নির্মাণ করেন। এর মধ্যে প্রধান ছিল গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড যা 'সড়ক-ই-আজম' নামেও পরিচিত ছিল। 

  • এ ছাড়াও তিনি বৃক্ষরোপণ, কুপখনন এবং পানশালা নির্মাণ করেন। 

  • তাঁর আমলে প্রথম ঘোড়ার পিঠে ডাক ব্যবস্থার প্রচলন ঘটেছিল।


 মৃত্যু: 

  • 1545 খ্রি. কালিঞ্জর দুর্গ জয় করতে গিয়ে বারুদ বিস্ফোরণে তাঁর মৃত্যু হয়।।





মুঘল সাম্রাজ্যের পুনঃ প্রতিষ্ঠাতা 


জালাল উদ্দিন মোঃ আকবর 1556 থেকে 1605 খ্রিস্টাব্দ:


পরিচয় ও রাজ্যাভিষেক: 


  • 1542 খ্রিস্টাব্দের 15-ই অক্টোবর, মুঘল সম্রাট জালাল-উদ্‌-দিন মহম্মদ আকবর পাকিস্তানের অমরকোটে রাজা বীরসালের প্রাসাদে জন্মগ্রহণ করেন, যখন তার পিতা হুমায়ুন, শেরশাহ সুরির হাতে সামরিক পরাজয়ের পর পালিয়ে যান।


  • তাঁর মাতা ছিলেন হামিদা বানু বেগম। তিনি 13 বছর 4 মাস বয়সে মুঘল সিংহাসনে বসেন।


সাম্রাজ্যবিস্তার: 


  • 1556 খ্রি: পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে অভিভাবক বৈরাম খাঁ-র নেতৃত্বে আকবর আদিল শাহের হিন্দু সেনাপতি হিমুকে পরাজিত করেন। 

  • 1560-1562 খ্রি. পর্যন্ত আকবরের ধাত্রীমাতা মাহম অনাঘার নেতৃত্বে 'অন্তঃপুরিকার শাসন' পরিচালিত হয়। 

  • তিনি 1561 খ্রি মালব জয় করেন 

  • 1564 খ্রি. গন্ডোয়ানা রাজা জয় করেন। এই যুদ্ধে নাবালক রাজা বীর নারায়ণ এবং তাঁর অভিভাবক রাজমাতা রানি দুর্গাবতী প্রাণ হারান। 

  • 1581 খ্রি. কাবুল  

  • 1586 খ্রি. কাশ্মীর দখল করেন। 

  • 1572 খ্রি. মুজাফফর শাহ-কে হত্যা করে গুজরাট অধিগ্রহণ করেন। 

  • 1575 খ্রি. তুকারাইয়ের যুদ্ধে বাংলার শাসক দাউদ কররানিকে পরাজিত করেন। 

  • 1570 খ্রি. বিকানির-এর কল্যাণমল ও জয়সলমীরের হররাই আকবরের বশ্যতা স্বীকার করেন। 

  • 1600 খ্রি আহম্মদনগর জয় করেছিলেন। 

  • তাঁর শেষ যুদ্ধ ছিল 1601 খ্রি. খান্দেশ জয় বা আসিরগড় দুর্গ দখল। 



রাজপুত নীতি: 


  • আকবর রাজপুতদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে তাদেরকে মুঘল সাম্রাজ্যের স্তম্ভে পরিণত করেন। 

  • এই সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে তিনি তিনটি নীতি গ্রহণ করেছিলেন, যথা- 

    • i) বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন,  

    • ii) মিত্রতা ও 

    • iii) যুদ্ধ জয় । 

  • তবে মেবারের রানাপ্রতাপ আকবরের বশ্যতা স্বীকার করেননি। 

  • 1576 খ্রি. তিনি আকবর দ্বারা হলদিঘাটের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেন এবং পরবর্তী দুই দশক ধরে মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান।।




রাজসভা: 


আকবরের রাজসভাকে নবরত্ন সভা বলা হত। এই সভার উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা ছিলেন আবুল ফজল, ফৈজি, তানসেন, বীরবল, টোডরমল, মানসিংহ, আবদুর রহিম খান-ই-খানান, ফকির আজিয়া ও মোল্লা দো পিয়াজা।


মনসবদারি ব্যবস্থা: 


  • আকবর 1577 খ্রি. ভারতে প্রথম মনসবদারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। 

  • মনসব শব্দের অর্থ হল পদ বা পদমর্যাদা। 

  • মনসবদারদের সর্বনিম্ন স্তর ছিল 10 এবং সর্বোচ্চ স্তর ছিল 500। 

  • একজন মনসরদার 'জাট''সওয়ার' পদের অধিকারী হতেন। 

  • মনসবদারদের ব্যক্তিগত পদমর্যাদার সূচককে 'জাট' ও মনসবদারদের অধীনে রাখা অশ্বারোহী সৈন্যের সংখ্যাকে 'সওয়ার' বলা হত। 

  • এই প্রথা বংশানুক্রমিক ছিল না। 

  • 500-এর উপর মনসবপ্রাপ্তদের আমীর-ই-ঊমদা বলা হত। পরবর্তীকালে 1000 এর নীচে সকলকেই মনসবদার বলা হত। 

  • আকবরের আমলে 7000 মনসব পেয়েছিলেন- মির্জা আজিজ কোকা, রাজা মানসিহ, কুলিচ খাঁ, টোডরমল। 

  • তাঁর আমলে মনসবদারদের 40টি স্তরের পরিকল্পনার কথা জানা যায় কিন্তু বাস্তবে ছিল 33টি স্তর। 



ধমনীতি: 

  • আকবর ধর্মনিরপেক্ষ, উদার ও প্রগতিশীল শাসক ছিলেন। 1563 খ্রি. হিন্দুদের ওপর থেকে তীর্থকর এবং 1564 খ্রি. জিজিয়া কর রদ করেন। 

  • তিনি ধর্ম আলোচনার জন্য 1575 খ্রি ইবাদতখানা প্রতিষ্ঠা করেন। 

  • এখানে অংশগ্রহণকারী সরিকগণ ছিলেন - 

    • i) পুরুষোত্তম দেবী (হিন্দু), 

    • ii) হরিবিজয় সুরি ও জিনচন্দ্র সুরি (জৈন), 

    • iii) দস্তুর মহারজি রানা (জরথ্রুষ্টীয়ান) প্রমুখ। 


  • 1578 খ্রি. তিনি মুসলিম ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিদের এই সভাকক্ষে প্রবেশের অধিকার প্রদান করেন। 

  • 1579 খ্রি. মাহজারনামা ঘোষণা করেন এবং  1582 খ্রি. তিনি দীন-ই-ইলাহি ধর্মমত প্রবর্তন করেন। তাঁর ধর্মনীতি সুল-ই-কুল নীতি নামে পরিচিত।

  • 1581 খ্রি. ধর্মীয় আলোচনায় পারস্পরিক দোষারোপের কারণে 1582 খ্রি. তিনি ইবাদৎখানা পূর্ণরূপে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। 

  • সম্রাট আকবরের সভা সদস্যদের মধ্যে মাত্র 18 জন তার এই ধর্ম গ্রহণ করেছিল। তাদের মধ্যে একমাত্র হিন্দু ছিলেন বীরবল।





প্রশাসনিক ব্যবস্থা: 


  • আকবর 1580 খ্রি. মুঘল সাম্রাজ্যকে 12টি সুবায় বিভক্ত করেন। পরবর্তীকালে আরও 2টি সুবা (দাক্ষিণাত্যের) যুক্ত হয়। 

  • ফৌজদারিদেওয়ানির প্রধান ছিলেন সুবাদার ও দেওয়ান। 

  • আমিল বা আমলগুজারের দায়িত্ব ছিল রাজস্ব সংগ্রহ করা । 

  •  কোতোয়াল সরকারের আইন-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ইত্যাদির রক্ষনাবেক্ষণ করতেন। 

  • তাঁর সময়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীকে বলা হত উজির। 

  • বৈরাম খাঁর অপসারণের পর 'ভকিল' পদের গুরুত্ব কমে যাওয়ায় 'উজির'ই বাদশাহ-র পরের স্থান দখল করেন। তাঁকে রাজস্ব বিভাগের দায়িত্ব বহন করতে হত।

  •  আকবর উজিরকে 'দেওয়ান-ই-আলা' সম্বোধন করতেন। 

  • মুঘল সামরিক প্রশাসনের এবং গুপ্তচর বিভাগের প্রধান ছিলেন মীরবক্সী। তিনি মনসবদারদের অর্থ অনুমোদন করতেন। 

  • এ ছাড়া বিভিন্ন প্রাদেশিক কর্মচারীরা ছিলেন- কাজি, মীরবহর প্রমূখ।



স্থাপত্য: 


তাঁর আমলে উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যকার্যগুলি ছিল- 

i) ফতেপুর সিক্রি, 

ii) আগ্রা দুর্গ, 

iii) বুলন্দ দরওয়াজা, 

iv) জাহাঙ্গির মহল ইত্যাদি।



________________



Post a Comment

Previous Post Next Post