Q। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর।

ভূমিকা: 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে যে আপাত শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল মাত্র ২০ বছরের মধ্যেই তা বিনষ্ট হয়ে যায়। শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর)। সামরিক কৌশলে, মারণাস্ত্রের অভিনবত্বে ও ক্ষয়ক্ষতির বিচারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে বহুদূর ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ভয়াবহ এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণে শুরু হয়নি। এর পিছনে নানাবিধ কারণ ছিল। 



• প্রত্যক্ষ কারণ : 

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর জার্মান সর্বাধিনায়ক হিটলার ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সকল সতর্কবাণী উপেক্ষা করে পোল্যান্ড আক্রমণ করে। এই পরিস্থিতিতে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ৩ সেপ্টেম্বর জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।


• পরোক্ষ কারণ:


(১) ভার্সাই সন্ধির ত্রুটি: 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভার্সাই সন্ধির মাধ্যমে জার্মানির ওপর চরম অবিচার করা হয়েছিল। এই সন্ধির অপমানজনক শর্তগুলি জার্মানদের মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। হিটলার যখন ভার্সাই সন্ধির বিরোধিতা ও জার্মানির মর্যাদাকে পুনরুদ্ধার করাকে তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য বলে ঘোষণা করেন তখন সমগ্র জার্মান জাতি তাঁকে সমর্থন জানিয়েছিল। জার্মানরা এই সন্ধিকে জবরদস্ত সন্ধি বলে মনে করত। তারা এই সন্ধি ভঙ্গ করে অপমানের প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর ছিল। অধ্যাপক ল্যাসিং-ও এ সম্পর্কে বলেছেন-ভার্সাই সন্ধি ছিল অস্বাভাবিক কঠোর ও অপমানজনক। এই সন্ধিতে জার্মানির অর্থনীতির মেরুদন্ডকে ভেঙে দেওয়ার পরেও তার ওপর ক্ষতিপূরণের বিরাট বোঝা চাপানো হয়। বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ ভার্সাই সন্ধির মধ্যেই নিহিত ছিল।


(২) আহত জার্মান জাতীয়তাবাদ: 

ভার্সাই সন্ধির মাধ্যমে জার্মানির সীমান্তের অঞ্চলগুলি নিয়ে নিলে জার্মান জাতীয়তাবাদ আহত হয়। জার্মান ভাষাভাষী বিভিন্ন অঞ্চল জার্মানি থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিতে ঢুকিয়ে দেওয়ায় জার্মানরা সেখানে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। ঐতিহাসিক ডেভিড টমসনের মতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী শান্তি চুক্তিগুলির দ্বারা ইউরোপের যে পুনর্গঠন হয়েছিল তা ছিল দূরদৃষ্টিহীন এবং জোড়াতালি দেওয়া কাজ। জার্মানির সুদেতান অঞ্চল চেকোশ্লোভাকিয়াকে ও পশ্চিম প্রাশিয়া পোল্যান্ডকে দিলে জার্মান জাতীয়তাবাদে আঘাত লাগে। ফলে জার্মান-চেক, জার্মান-পোল বিরোধ দেখা দিলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।


(৩) হিটলারের আগ্রাসী নীতি: 

জার্মানির নাৎসি নেতা হিটলারের নগ্ন আগ্রাসী নীতি ও পাশবিক কূটনীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য অনেকাংশে দায়ী ছিল। তিনি ছিলেন উগ্র জাতীয়তাবাদী। তিনি ছলে, বলে, কৌশলে একের পর এক প্রতিবেশী রাজ্য (অস্ট্রিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া) গ্রাস করতে থাকেন। তিনি অক্ষশক্তির চুক্তির দ্বারা ইউরোপ ও আফ্রিকায় ফ্যাসিবাদী সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা করেন। বুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তির দ্বারা তিনি রাশিয়াকে পশ্চিমী দেশগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন রাখেন।



(৪) স্পেনের গৃহযুদ্ধ:

 ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে স্পেনের গৃহযুদ্ধ শুরু হলে ইটালি ও জার্মানি স্পেনে ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে একনায়কতন্ত্রের শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এই গৃহযুদ্ধে অংশ নেয়। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স চুপচাপ থাকে। শেষ পর্যন্ত ফ্রাঙ্কো স্পেনে একনায়কতন্ত্র স্থাপন করেন। ঐতিহাসিক ল্যাংসাম এই গৃহযুদ্ধকে 'ক্ষুদ্র বিশ্বযুদ্ধ' বলে বর্ণনা করেছেন। এভাবে স্পেনের গৃহযুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহড়া বা ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।


(৫) জার্মান তোষণনীতি: 

মিত্রপক্ষের দেশগুলির কোনো ঐক্যবদ্ধ পররাষ্ট্রনীতি না থাকায় জার্মানির শক্তি সঞ্চয়ের পক্ষে সহায়ক হয়েছিল। ইংল্যান্ড জার্মানির সঙ্গে নৌচুক্তি করে পরোক্ষে জার্মানিকে ভার্সাই সন্ধি ভঙ্গ করতে উৎসাহ দেয়। মিউনিখ চুক্তির মাধ্যমে ইংল্যান্ড চেকোশ্লোভাকিয়াকে জার্মানির হাতে উপহার দেন। ফ্রান্সও নীরব থাকল। এভাবে তোষণনীতির মাধ্যমে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স জার্মানির শক্তি বৃদ্ধি করে। ঐতিহাসিক এ. জে. পি. টেলরের মতে, ইঙ্গ-ফরাসি শক্তির জার্মান তোষণনীতি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ।




দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল:


• অক্ষশক্তির পরাজয়:

 মানবসভ্যতার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া অর্থাৎ, মিত্রশক্তি জয়লাভ করে এবং জার্মানি, জাপান ও ইটালি অর্থাৎ, অক্ষশক্তি পরাজয় বরণ করে।


• বিপুল ক্ষয়ক্ষতি: 

এই যুদ্ধে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্র প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। কয়েক কোটি মানুষ হতাহত হন। বিপুল পরিমাণ ধনসম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়।


• জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের তীব্রতা: 

বিভিন্ন দেশের অধীনস্থ উপনিবেশগুলিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ফলে এশিয়া ও আফ্রিকার পরাধীন দেশগুলির অধিকাংশ ক্রমে ক্রমে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে।



• সমাজতন্ত্রবাদের উদ্ভব: 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে চিন, পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশে ও অন্যান্য স্থানে সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে বিশ্বে সমাজতন্ত্রবাদের প্রসার ঘটে।


• ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা: 

বিশ্ব রাজনীতিতে দুটি প্রধান শক্তিরূপে আবির্ভূত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়া। এই দুই বৃহৎ শক্তিকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ক্রমশ পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। শুরু হয় ঠান্ডা যুদ্ধ।


 • সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের প্রতিষ্ঠা: 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতায় আন্তর্জাতিক উত্তেজনা প্রশমনের প্রয়োজনীয়তা থেকেই এবং বিশ্বশান্তি ও আন্তর্জাতিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হয় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (United Nations Organization বা UNO)।


____________&&____________






Post a Comment

Previous Post Next Post