Shuvajoy Roy 

Ph.D Research Scholar 


সুতাবস্ত্র শিল্প

উনিশ শতকের অন্তিম লগ্ন পর্যন্ত ভারতীয় বস্ত্র উৎপাদনে হস্তচালিত তাঁতের (Handloom) প্রাধান্য লক্ষ করা গিয়েছিল। ১৯০০-১৯০১ সাল নাগাদ হস্তচালিত তাঁতের মাধ্যমে ৬৪৬.৪ মিলিয়ন গজ কাপড় তৈরি হত, যা ছিল মোট বস্ত্র উৎপাদনের ৬০.৫ শতাংশ। ১৯০৯-১০ সাল পর্যন্ত এই পরিস্থিতি মোটামুটি অপরিবর্তিত ছিল। সুতাবস্ত্র শিল্পের সূচনা ঘটেছিল পশ্চিম ভারতে। প্রথম ভারতীয় কাপড়ের কল ১৮৫৬ সালে বম্বেতে তৈরি হয়। প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন সি. এন. ডাবর। তিনি দু'টি ইংরেজ বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে মুৎসুদ্দি (Comprador) হিসাবে যুক্ত ছিলেন এবং বাণিজ্য ও মহাজনী কারবার মারফৎ প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। অন্য একটি মিল তৈরি করেন মানেকজি পেটিট। ১৮৬০-এর দশকে পশ্চিম ভারতের আমেদাবাদ ও শোলাপুরে এবং দক্ষিণ ভারতে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির বিভিন্ন স্থানে অনেকগুলি বস্ত্র তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। ১৮৭৫ সালের পর থেকে বম্বে প্রেসিডেন্সিতে দ্রুত হারে প্রচুর কাপড়ের কল গড়ে উঠতে থাকে। ১৮৭৪-৭৫ সাল নাগাদ এই অঞ্চলে মিলের সংখ্যা ছিল ১২। ১৯১৪ সালে এখানে ৮৫টি মিল চালু ছিল। ঐ বছর কেবলমাত্র আমেদাবাদেই কাপড়ের মিল ছিল ৪৯টি। পশ্চিম ভারতের বস্ত্রশিল্পে বিনিয়োগ করা হয়েছিল মূলত ভারতীয় পুঁজি এবং স্বাভাবিকভাবে সেগুলির ওপর ভারতীয় শিল্পপতিদের নিয়ন্ত্রণ ছিল। দক্ষিণ ভারতের বস্ত্রশিল্প নিয়ন্ত্রণ করত ব্রিটিশ বিনিয়োগকারীরা। বস্ত্রশিল্পের ক্ষেত্রে স্টার্লিং কোম্পানির সংখ্যা ছিল খুবই কম। মরিস, ডি. মরিস লিখেছেন-টাকা এবং স্টার্লিং-এর সম্মিলিত বিনিয়োগ ধরলে এই শিল্পে বিদেশি পুঁজির হার ১০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশের বেশি ছিল না। ১৯১৪ সালের আগে গোটা ভারতবর্ষে ১৫টি সুতাবস্ত্র কারখানা খোলা হয়। এগুলির মধ্যে মাত্র ১৫টি ইউরোপীয় পুঁজি ও পরিচালন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন। এই ১৫টি মিলের মধ্যে আবার ১২টি মিলকে নিয়ন্ত্রণ করত গ্রিভস-কটন কোম্পানি ও ব্র্যাডবুরি-ব্র্যাডি কোম্পানি নামক দু'টি ম্যানেজিং এজেন্সি সংস্থা। এন. তোয়াবজি লিখেছেন-দক্ষিণ ভারতে ১৯২০ থেকে ১৯৩৭ সালের মধ্যে মোট ৪৩টি কাপড়ের মিলের অস্তিত্ব ছিল। পশ্চিম উপকূলের কোয়েম্বাটুর এবং তেলেগুভাষী অঞ্চল ব্যতিরেকে সবকটি মিলেই ইউরোপীয়দের প্রাধান্য ছিল। পশ্চিম ভারতের বস্ত্রশিল্পে অধিকাংশ ভারতীয় বিনিয়োগকারী ছিলেন পার্সি। দক্ষিণে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন চেট্রিয়ার মহাজনরা এবং নাইডু সম্প্রদায়ের মানুষ।

উনিশ শতকের ভারতীয় বস্ত্রশিল্প ছিল মূলত বুনন শিল্প। তৈরি বস্ত্র বিশেষ উৎপাদিত হত না। মূলত সুতো (yarn) বোনা হত এবং পাকের সুতো (twist) তৈরি হত। বম্বের বণিকরা সেই সুতো ভারতের বিভিন্ন স্থানের তাঁতিদের পাঠাতেন এবং চীনে রপ্তানি করতেন। উনিশ শতকের শেষদিকে মূলত ল্যাঙ্কাশায়ারের চাপে ভারতের ব্রটিশ সরকার সুতোর ওপর আমদানি শুল্ক অনেকটাই কমিয়ে দেয়। ফলে ভারতীয় মিল মালিকরা অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হন এবং অসুবিধায় পড়েন।

ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের কাঠামোয় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষিত হয় বিশ শতকের সূচনাপর্বে। কাপড়ের কলগুলি অধিক পরিমাণে থানকাপড় (piece goods) তৈরি করতে থাকে। ১৯০০-০১ সাল নাগাদ ভারতীয় মিলগুলি ৪২০.৬ মিলিয়ন গজ থানকাপড় তৈরি করেছিল। ১৯১০-১১ সালে এই পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১০৪২ মিলিয়ন গজ। আর ১৯৩৮-৩৯ সাল নাগাদ ৩,৯০৫ মিলিয়ন গজের বেশি থানকাপড় উৎপাদন করেছিল ভারতের মিলগুলি। অভ্যন্তরীণ বাজারে সব চাইতে বেশি থানকাপড়ের যোগান দিত ভারতীয় মিলগুলি। ১৯০০ সালের অল্প কিছুকাল পর অধিক কার্যকরী কারখানাগুলির প্রয়াসে বিরঞ্জন (Bleaching) ও রং করার সুযোগসুবিধা সৃষ্টি হতে থাকে। ১৯০৫ সালের পর যখন বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বিকশিত রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলশ্রুতি হিসাবে ভারতীয় কাপড়ের ব্যবহার বাড়তে থাকল, তখন বম্বের কারখানাগুলিতে বিরঞ্জন ও রং করার নিজস্ব ব্যবস্থা থাকাটা স্বাভাবিক হয়ে উঠল। অমিয়কুমার বাগচী লিখেছেন-এই উন্নতির প্রক্রিয়াটিকে উস্কে দিল চীনে সুতো রপ্তানির বাজারের রমরমা অবস্থাটির অনেকাংশে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ঘটনা। সুতো রপ্তানি হ্রাসের ফলাফল প্রতিফলিত হল শুধুমাত্র সুতো তৈরিতে নিয়োজিত কারখানাগুলির দ্রুত পতনে এবং থানকাপড় বয়নের কারখানাগুলির আপেক্ষিক মুনাফা লভ্যতার বৃদ্ধিতে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে থানকাপড় প্রস্তুতকারী সুতাকলের সংখ্যা ও গুরুত্ব বাড়তে থাকে। হস্তচালিত তাঁতের সংখ্যা কমতে থাকে। ১৯০০ থেকে ১৯০৫ সালের মধ্যে মোট ভারতীয় বস্ত্রের ৩৯.৪ শতাংশ উৎপাদিত হত যন্ত্রচালিত মিলগুলিতে। ৬০.৬ শতাংশ উৎপাদন করত হস্তচালিত তাঁতগুলি। কিন্তু ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে হস্তচালিত তাঁতের মাধ্যমে উৎপাদিত হত মাত্র ২৮.৭ শতাংশ আর মিলগুলি মারফত উৎপাদিত হত ৭১.৩ শতাংশ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে যন্ত্রচালিত তাঁতের অনুপাতে সুতোকাটার টাকুর সংখ্যা ক্রমশ কমতে থাকে। ভারতীয় থানকাপড়ের বর্ধিত চাহিদাই এর মূল কারণ। কিন্তু ১৯৩০-এর দশকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতীয় সুতিবস্ত্রের চাহিদা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। কারণ জাপান থেকে আমদানিকৃত বস্ত্রের প্রতিযোগিতা ভারতীয় সুতিবস্ত্র শিল্পকে যথেষ্ট চাপে ফেলে দেয়। ১৯১৫-১৬ সাল নাগাদ মাত্র ৩৯ মিলিয়ন গজ সুতিকাপড় জাপান থেকে ভারতে আমদানি করা হত। ১৯৩৯-৪০ সাল নাগাদ জাপান থেকে ভারতে আমদানিকৃত সুতাবস্ত্রের পরিমাণ বেড়ে হয় ৩৯৩ মিলিয়ন গজ। আমদানি বৃদ্ধির হার ছিল ১০ গুণেরও বেশি। তা সত্ত্বেও বলা যায়, প্রথমে ল্যাঙ্কাশায়ারের প্রতিযোগিতা এবং পরবর্তী স্তরে জাপানের প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে ভারতীয় বস্ত্রশিল্প যথেষ্ট গুরুত্ব অর্জন করেছিল এবং অন্তত কিছু ক্ষেত্রে সরকার এই শিল্পের স্বার্থ সংরক্ষণে যত্নবান হয়েছিল।


Source: আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাস (১৭০৭-১৯৬৪), সিদ্ধার্থ গুহ রায় ও সুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা-৪৮৬-৪৮৮,  প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা।


Post a Comment

Previous Post Next Post