[সকল NET/SET পরীক্ষার্থীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ]
বিদেশিদের ভারতীয় করণ প্রক্রিয়া গুপ্ত যুগের শেষ লগ্নেও দেখা যায়। এ সময় হুন নামে এক বিদেশী জাতি ভারতে প্রবেশ করে এক শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। প্রথম কুমার গুপ্ত এর মৃত্যুর অল্পকাল পরে স্তেপি অঞ্চল থেকে দুর্ধর্ষ হুন-রা বেরিয়ে এসে গুপ্ত সাম্রাজ্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং পাঞ্জাব ও পূর্ব মালব অধিকার করে নেয়। স্কন্দ গুপ্তের রাজত্বকাল এর গোড়ার দিকে হুনরা গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রবেশ করলেও সেখান থেকে বিতাড়িত হন এবং পরবর্তীতে স্কন্দ গুপ্তের মৃত্যুর পর গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রবেশের পথ তাদের কাছে খুলে যায়। রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় কৃষ্ণের সমসাময়িক জৈন লেখক সোমদেবের বর্ণনা অনুযায়ী চিত্রকূট পর্যন্ত গুপ্ত সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে হুনরা প্রবেশ করেছিল। তারা মধ্যপ্রদেশের এরান অঞ্চলটি অধিকার করেছিলেন এবং পরবর্তীতে ভারতে তাদের প্রধান ঘাঁটি ছিল পশ্চিম পাঞ্জাবের কয়েকটি অঞ্চল।
মহাভারতের সভাপর্ব, মৎস্য পুরাণ ও রঘুবংশে হুন দের উল্লেখ আছে। অন্যান্য বিদেশীদের মত হুনরাও ভারতীয় ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিল।
ভারতে হুন আক্রমণ |
তোরমান:
তোরমান এর মুদ্রার নাম 'তোরমানশাহী'। তিনি উত্তর প্রদেশ, মালব, পাঞ্জাব জয় করেন। তার উপাধি ছিলো- মহারাজা, মহারাজা ধীরাজ প্রভৃতি। তোরমান সম্পর্কে মালবের ইরণ নামক স্থানে একটি শিলালিপি উৎকীর্ণ হয়েছে। তার মুদ্রায় সূর্যের প্রতীক চিহ্ন পাওয়া যায়। ভারতের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন তিনি ধন্যবিষ্ণু নামক একজন ব্যক্তিকে। পরাস্ত হয়েছিলেন মালবের রাজা ভানুগুপ্তের কাছে। কিছুকাল পর তোরমনের ক্ষমতার অবক্ষয় দেখা দিয়েছিল এবং তিনি পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত সিন্ধু নদীর অপর পারে তার কর্তৃত্ব সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তোরমান রাজত্ব করতেন সিন্ধু নদের পশ্চিম তীরে। জৈন গ্রন্থ কুবলয় মালায় বলা হয়েছে তিনি শেষ জীবনে জৈন ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং চন্দ্রভাগা নদীর তীরে পব্বৈয়া গ্রামে বাস করতেন।
তোরমান এর মুদ্রার |
মিহিরকুল:
515 খ্রিস্টাব্দে মিহিরকুল সিংহাসনে বসেন। তার সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় কুরা শিলালিপি থেকে। এছাড়াও গ্রিক লেখক কসমস এর ক্রিশ্চিয়ান টপোগ্রাফি, কলহন -এর রাজতরঙ্গিনী এবং হিউ এন সাং এর বিবরণ প্রভৃতি থেকে মিহিরকুল সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। তার বর্ণনা অনুযায়ী মিহির কুলের রাজধানী ছিল সাকল বা শিয়ালকোটে, তিনি ভারতে রাজত্ব করতেন। 530 খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ করা তার রাজত্বকালের একখানি লেখ (কুরা লিপি) থেকে জানা যায় গোয়ালিয়র পর্যন্ত তার রাজ্য বিস্তৃত ছিল, গোয়ালিয়র এর পরেও ভারতীয় রাজারা তার কর্তৃত্ব মেনে নিতে বাধ্য হন।
531 খ্রিস্টাব্দে রাজা যশোধর্মন এর কাছে মিহিরকুল পরাস্ত হন, এছাড়াও নরসিংহ গুপ্ত বালাদিত্য এর কাছে পরাস্ত হন। হিউ এন সাং এর বিবরণ থেকে জানা যায় নরসিংহ গুপ্ত বালাদিত্য এর কাছে মিহিরকুল মোট দুইবার পরাস্ত হন। আদিত্য সেন এর আফসর অভিলেখতে হুনদের বিরুদ্ধে মৌখরী রাজ ঈশান বর্মার বিজয় লাভের ইঙ্গিত আছে। নরসিংহ গুপ্ত ছিলেন বৌদ্ধধর্মাবলম্বী এবং রাজা যশোধর্মার মান্দাসর লিপিতে বলা হয়েছে মিহিরকুল ছিলেন শৈব ধর্মাবলম্বী। শেষ পর্যন্ত নরসিংহ গুপ্তের কাছে মিহিরকুল চূড়ান্তভাবে পরাজয় বরণ করেন।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রবেশের পথ |
ষষ্ঠ শতকের মধ্যভাগে লিখিত গ্রিক লেখক কসমস এর ক্রিশ্চিয়ান টপোগ্রাফি তে হুন রাজাদের ভারতের উত্তর দিকে শ্বেত হুনরা রয়েছে বলে বর্ণনা করা আছে। গল্লাস বা মিহিরকুল নামক রাজাদের সম্পর্কে বর্ণনা আছে, যারা দুই হাজার হাতি নিয়ে যুদ্ধ করেন সঙ্গে থাকে একটি বিশাল অশ্বারোহী বাহিনী। ইনি ভারতের অধীশ্বর। জনগণের ওপর অত্যাচার করেন, তাদের কবর দিতে বাধ্য করেন, সিন্ধু নদীর পশ্চিম দিকে সব অঞ্চলের ওপর তিনি রাজত্ব করেন। কসমাস আরও জানিয়েছেন হুন রাজা ভারতীয় রাজাদের ওপর সার্বভৌমত্ব স্থাপন করেছেন, তাদের কর দিতে বাধ্য করেন।
মিহিরকুল এর মুদ্রায় লক্ষী, শিব প্রভৃতি দেবদেবীর ছবি খোদাই করা ছিল। তার মুদ্রায় বৃষের প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ আছে। বৃষ শিবের প্রতীক, তিনি শিবের পরম ভক্ত ছিলেন। তার শিলালিপি বৌদ্ধবিহার ও সূর্য মন্দির নির্মাণ সম্পর্কে তথ্য দেয়। হুন রাজা মিহির কুলের সময়ে মাতৃচেত নামে জনৈক ব্যক্তি গোয়ালিয়রের পর্বতশিখরে একটি সূর্য মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। এ পর্বে সৌর উপাসনা জনসমাজে যে যথেষ্ট সমাদর লাভ করেছিল তাতে কোনো সংশয় নেই। শেষ জীবনে মিহিরকুল বৌদ্ধবিহার তৈরি করেন।
রাজ তরঙ্গিনী থেকে জানা যায় মিহিরকুল কাশ্মীর, গান্ধার, দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কা জয় করেন। হিউ এন সাং এর বিবরণ থেকে জানা যায় মিহিরকুল সারা ভারত জয় করেন। রাজ তরঙ্গিনী ও হিউ এন সাং এর বিবরণে তার বহু হৃদয় বিদারক নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডের উল্লেখ আছে।
গান্ধারের হুন রাজার দরবারে সং ইয়ুন (Sung-yun) নামক একজন চিনা দূত 520 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এসেছিলেন। তার বর্ণনা থেকে হুনদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির ধারণা পাওয়া যায়। তিনি হুনদের রাজ্য জয়, রাজ্যের পরিচয়, হুন রাজাদের রাজসভা, রাজার বর্ণনা এবং তাদের নিষ্ঠুর প্রকৃতির প্রতিশোধ পরায়ন ও অত্যন্ত নিষ্ঠুর, বর্বরোচিত কাজকর্ম প্রভৃতির উল্লেখ করেছেন।
হুনদের মুদ্রা |
মিহির কুলের মুদ্রায় সংস্কৃত ভাষা ও ব্রাহ্মী লিপির ব্যবহার দেখা যায়। রাজা রাজড়াদের আদর্শ অনুসরণ করে হুন গোষ্ঠীর অন্যান্য সদস্যরাও ভারতীয় ধর্ম এবং সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিলেন। হুনরা পরবর্তী যুগে রাজপুতদের 36টি বিশুদ্ধ শাখার একটি রূপে স্বীকৃতি লাভ করেন। দামোদর গুপ্ত এর আফসর লেখে বীরত্বপূর্ণ কার্যকলাপ সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। উক্তিটি এরূপ: যে মৌখরীর দুর্মদ হস্তী বাহিনী হুন সৈন্যদের চূর্ণ-বিচূর্ণ করে, দামোদর গুপ্ত সেই রণ হস্তি গুলিকে ছত্রভঙ্গ করে সংমূর্ছিত হন এবং সুর বধূদের করস্পর্শে সংজ্ঞা লাভ করেন। হুন দের শক্তি এবং বীরত্বের প্রশংসা করে বানভট্ট পুষ্যভূতি রাজা প্রভাকর বর্ধন কে 'হুনহরিণকেশরী' বলে উল্লেখ করেছেন। বাদল প্রশস্তি তে দেবপাল দাবি করেছেন যে তিনি উৎকল ও হুনদের পরাজিত করেছিলেন।
মালবের যশোধর্মন দাবি করেছেন যে শক্তিশালী হুন রাজা মিহিরকুল তার কাছে বশ্যতা স্বীকার করে তাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। যশোধর্মনের পতনের পর মিহিরকুল আবার ভারতীয় রাজনীতিতে প্রাধান্য স্থাপন করেন। এই সময় মগধের শাসক ছিলেন নরসিংহ গুপ্ত বালাদিত্য। হিউ এন সাং জানিয়েছেন যে নরসিংহ গুপ্ত বিপর্যস্ত হয়ে মিহিরকুল কে কর দিতে বাধ্য হন। শেষ পর্যন্ত বালাদিত্য তার হন প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাস্ত করতে সক্ষম হন। মিহিরকুল নরসিংহ গুপ্তের হাতে বন্দী হন এবং তার মাতার হস্তক্ষেপে গুপ্ত রাজা তাকে মুক্তি দেন। এরপর মিহিরকুল কাশ্মীরে ফিরে গিয়ে কাশ্মীর ও গান্ধারের সব স্তূপ ও বিহার ধ্বংস করেন। গুপ্ত সাম্রাজ্য মিহির কুলের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পায়।
মিহির কুলের পরাজয়ের পর ভারতে তাদের রাজনৈতিক আধিপত্যের অবসান ঘটেছিল এবং ভারতে তারা একটি ক্ষুদ্র সম্প্রদায় হিসেবে ভারতীয় সমাজে মিশে যায়। তাদের ভারতের সামাজিক মিশ্রণ ঘটে এবং জীবন ধারার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় রাজপুত ও অন্যান্য উপজাতি রক্তধারায় হুন রক্ত মিশে গিয়েছিল বলে পণ্ডিতদের বক্তব্য।
ভারতীয়রা রাজারা হুনদের অনুকরণ করে নতুন ধরনের মুদ্রা প্রবর্তন করেন
Post a Comment