জাতীয় আন্দোলনে গৌড়বঙ্গের গ্রন্থাগার, ব্যায়াম সমিতি ও পত্রপত্রিকা
শুভজয় রায় (গবেষক)
রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়।
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ
ভূমিকা
আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ, গ্রন্থাগার, ব্যায়াম সমিতি, পত্রপত্রিকা, চিঠিপত্র, সরকারি নির্দেশনামা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। ভারতবর্ষের জাতীয় আন্দোলনে উত্তরবঙ্গের অন্তর্গত গৌড়বঙ্গ যে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল তার উপাদান হিসেবে আমরা গ্রন্থাগার ব্যায়াম সমিতি ও পত্র-পত্রিকার গুরুত্ব এই প্রবন্ধে আলোচনা করবো।
ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে সংবাদপত্রের হাত ধরে দেশে জাতীয়তাবাদের এক জোয়ার এসেছিল। কলকাতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উত্তরবঙ্গেও সেই সময় বহু সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। দেশ চেতনার বিস্তার, সামাজিক গঠনের পরিকল্পনা, নিজস্ব সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে প্রকাশ করার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এই পত্র-পত্রিকাগুলির লক্ষ্য।' এর সাথেই বৈপ্লবিক আন্দোলনগুলোকে সংগঠিত করার জন্য অনুশীলন সমিতি ও ব্রতীসংঘ মালদহে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। আলালের মহেন্দ্র দাস (জেল ১৪ বছর), পিপলার বিভূতিভূষণ চক্রবর্তী, অনাথবন্ধু ঘোষ ও মল্লিকপুরের দেবেন্দ্র দাস অনুশীলন সমিতির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। রাজাবাজার বোমার মামলার সঙ্গে জড়িত স্বদেশ পাকড়াশী মালদাতেই আত্মগোপন করেছিলেন। এই অনুশীলন সমিতি ঢাকার কেন্দ্রীভূত অনুশীলন সমিতি দ্বারা পরিচালিত হত। এইসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিপ্লবী কর্মীদের রিক্রুটিং সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করা হত। বিপ্লবীদের পঠন পাঠান ও শরীরচর্চার জন্য গ্রন্থাগার ও ব্যায়াম সমিতি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এই প্রতিষ্ঠানগুলির পরিচালনার দায়িত্বে থাকতেন জেলা নেতৃবৃন্দ এবং আর্থিক সাহায্য করতেন এই জেলার জাতীয়তাবাদী ধনী ব্যক্তি বা ব্যবসায়ীগণ।
মালদা জেলার ভৌগোলিক অবস্থান
আধুনিক জেলা ও জেলা শাসনব্যবস্থা ঐতিহাসিকরা ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্ণর জেনারেল লর্ড কর্ণওয়ালিসের অবদান হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। কর্ণওয়ালিস ইংল্যান্ডের জেলা গঠনের ধাঁচে শাসনকার্যের সুবিধার জন্য ভারতেও ইংরেজ কোম্পানির অধিকৃত অঞ্চলে জেলা তৈরি করেছিলেন। ফলে কর্ণওয়ালিসের সময় উত্তরবঙ্গেই দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী প্রভৃতি জেলার উদ্ভব হয়েছিল। মালদহ জেলার জন্ম হয়েছিল ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে। মালদহ বর্তমান উত্তরবঙ্গের প্রাচীনতম জেলা যা গৌড়বঙ্গ নামে সমধিক পরিচিত।
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে মালদহ জেলায় প্রতিবাদ দেখা যায়। মালদহের কৃষ্ণজীবন সান্যাল আলিপুর বোমা মামলায় জড়িত থাকার কারণে পুলিশের নজর মালদা জেলার দিকে এসে পড়ে। সেই সময় পুলিশের নজর ও লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকার জন্য মালদহে বিপ্লবীরা বিভিন্ন গ্রন্থাগার ও ব্যায়াম শালা প্রতিষ্ঠা করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল (১) পুলিশের অগোচরে মিলিত হওয়া (২) গোপনে বিপ্লবী কার্যকলাপ-এর রূপরেখা নির্ণয় করা। (৩) পত্র পত্রিকার মাধ্যমে জনমত গঠন করা (৪) গ্রন্থাগারে স্বদেশ ভক্তিমূলক পুস্তক পাঠ করে সুনাম অর্জন করা (৫) ব্যায়ামাগারে শরীরচর্চা করে সুকঠোর বিপ্লবী হওয়া। (৬) প্রতিষ্ঠিত সকল গ্রন্থাগার ও ব্যায়ামাগারের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে বৃহত্তর আন্দোলন পরিচালনা করা (৭) সংগঠনগুলির মুখপত্র হিসেবে পত্রপত্রিকা গুলির প্রকাশ করা।
গ্রন্থাগার
মালদহ জাতীয় শিক্ষা সমিতির উদ্দেশ্যে যখন মালদহ জেলা জুড়ে স্বদেশী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ধারা বয়ে চলেছে সেই সময়ই গোলাপট্টিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল 'সরস্বতী পাঠাগার'। এই পাঠাগারে বই পড়তে আসতেন জেলার বিভিন্ন বিপ্লবীরা। এই পাঠাগারে সরযুপ্রসাদ বিহানীদের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য মিলত। এই পাঠাগার ১৯২৬ সালে পাকা দালান বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন দ্বারিকাদাস বিহানী। এখানে স্বদেশী যুবকদের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য বেছে নেওয়া হত। পূর্ববর্তীকালে গোলাপট্টীতে দীনবন্ধু পাঠশালা প্রতিষ্ঠিত হলে স্বদেশি শিক্ষার এক প্রকৃষ্ট বাতাবরণ গড়ে ওঠে। মকদুমপুরে ঠাকুরদাস বাবুর ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছিল যদু মাস্টারের পাঠশালা। এই পাঠশালায় অগ্নিযুগে দুর্গাপুজোর প্রচলন হয়েছিল ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে। মালদহে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় বিদ্যালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল এখানে কারিগরিবিদ্যা ছাত্র-ছাত্রীদের শেখানো হত।"
গোলাপট্টীতে 'সরস্বতী লাইব্রেরী' প্রতিষ্ঠার সমসাময়িক কালে কুতুবপুরে প্রতিষ্ঠিত হল 'সারদা লাইব্রেরি'। এই গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠার উদ্যোগী ছিলেন শ্রীপতিনাথ মৈত্র, তিনি মালদহে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। 'সারদা লাইব্রেরী' অন্যান্য লাইব্রেরীর মত স্বদেশ ভক্ত বিপ্লবী দলের মানসিক আহার সরবরাহ করত। এই লাইব্রেরির আজেবাজে বইয়ের মলাটের তলায় থাকত ইংরেজদের আমলে নিষিদ্ধ বইগুলো। যা পড়ে স্বদেশ ভক্ত বিপ্লবীরা তাদের আদর্শের পথে চলার জন্য অনুপ্রেরণা পেতেন। এই লাইব্রেরির পিছনে চলত ব্যায়ামশালা, যা ছিল দেহ ও মন গঠনের অসাধারণ ঔষধি।
স্বাধীনতাকামী যুবকদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বিনয় কুমার এর উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে সামান্য কিছু বই নিয়ে অভিরামপুরে অমরেন্দ্র কৃষ্ণ ভাদুড়ীর বাসভবনের বৈঠক খানায় প্রতিষ্ঠিত হয় 'বীণাপানি লাইব্রেরী'। পরে বলদেবানন্দ গিরির বাড়িতে মহাকালী পাঠশালা প্রতিষ্ঠা হলে বীণাপানি লাইব্রেরীটা উঠে আসে সেই বিদ্যালয়ে। বলদেবানন্দ গিরির বাড়ির পিছনেই ছিল ব্যায়ামাগার।
স্বদেশী যুগে মেয়েদের শিক্ষাদান করার জন্য বলদেবানন্দ গিরি মহাকালী পাঠশালা নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গৌড়বঙ্গ-এ নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন এক বলিষ্ঠ প্রচারক। এই বিদ্যালয়ে পঠন-পাঠনের সঙ্গে সঙ্গে চলত স্বাধীনতা যুদ্ধের সেনানী তৈরি করা। দেশবরেণ্য নেতারা মালদহে এলে তার জাহাজ বাড়িতেই উঠতেন। জাতীয় নেতাদের বরণ করে নেওয়া এই মহাকালী পাঠশালার মেয়েরাই করতেন। সভামঞ্চে দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করা, মঞ্চে বিভিন্ন কাজের তদারকি করা এই মেয়েদের উপরেই দায়িত্ব দেওয়া থাকত। বিদ্যালয়ের কৃতিছাত্রীদের পুরস্কার প্রদান জাতীয় স্তরের নেতাদের দিয়েই সম্পন্ন হত। পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হত চরকা ও স্বদেশি জিনিসপত্র। মালদহের মহিলা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এই বিদ্যালয়ের সাথে সংযোগ ছিল।
মালদহের রাজনৈতিক চেতনার গুরুদেব বিপিন বিহারী ঘোষের স্মরণে প্রতিষ্ঠিত হয়। 'বিপিন বিহারী স্মৃতি পাঠাগার'। তিনি ছিলেন বিনয় কুমার সরকারের শিক্ষক। মালদহ জাতীয় শিক্ষা সমিতির সম্পাদক রূপে তিনি দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন এবং জাতীয় শিক্ষা প্রসারের জন্য বহু কৃতি ছাত্রকে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি একটি জাতীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। এই গ্রন্থাগার পরিচালনা করতেন সুধীর কুমার রাহা। বিপিন বিহারী স্মৃতি পাঠাগার 'মহানন্দ' নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করত। এই পাঠাগার নিয়ে রাজকোষের জন্য জগদীশচন্দ্র রাহা ও সুধীর কুমার রাহাকে বহু কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছিল। সরকার বহুবার এই পাঠাগারকে বিধ্বস্ত করেছিল তবুও বিপিনবিহারী স্মৃতি পাঠাগার তার কর্তব্য পালন করে গিয়েছিল।১০
ব্যায়াম সমিতি
দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার আর এক প্রাণবন্ত প্রতিষ্ঠান ছিল 'গান্ধী হিন্দু ধর্মশালা'। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে দ্বারিকা দাস বিহানী এই প্রতিষ্ঠানকে স্বদেশ ভক্তির কার্যসূচির বিভিন্ন দিককে সম্প্রসারিত করার জন্যই এই ধর্মশালার প্রতিষ্ঠা করেন। পারিবারিক সূত্রেই তিনি স্বদেশভক্তির পাঠ পেয়েছিলেন। ইংরেজ অত্যাচারের পটভূমি দেখে তিনি অনুভব করেছিলেন সুস্থ ও শক্ত দেহ ছাড়া স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রকৃত সৈনিক হওয়া যায় না। তাই তিনি গান্ধীধর্মশালার মাঠে ব্যায়ামাগারও চালু করেছিলেন। এই কাজে তাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন বলদেবানন্দ গিরি। এই ব্যায়ামশালা সকলের জন্যই খোলা ছিল। এখানে প্যারালালবার, চিনিং দি বার, বারবেল, চেস্ট এক্সপ্যান্ডার-এর যাবতীয় দ্রব্য ছিল। এছাড়া মুণ্ডর ভাঁজা, লাঠিখেলা, ছোড়া খেলা শেখানো হত। ব্যায়ামবীর কেষ্ট মাস্টার দ্বারিকা দাসের ব্যায়ামশালায় শিক্ষা দিতেন। পরবর্তীতে এই ধর্মশালায় পলাতক বিপ্লবীরা আশ্রয় নিতেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের বহুকর্মীও এই ধর্মশালায় আশ্রয় নিতেন। এখাবে বহু রাজনৈতিক অনুষ্ঠান সমিতির বৈঠক ও জেলা কংগ্রেসের আন্দোলনের রূপরেখা রচিত হত। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি সকালবেলায় গান্ধী ধর্মশলায় সরযুপ্রসাদ বিহানী তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলন করে স্বাধীনতা দিবস পালন করেছিলেন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ও আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট নেতা মিস্টার ফিলিপ স্প্রাট এই গান্ধী ধর্মশালাতে সভা অনুষ্ঠান করেছিলেন।"
গৌড়বঙ্গের জাতীয় চেতনায় ব্যায়ামাগার ও নাটক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। গান্ধী হিন্দু ধর্মশালার ব্যায়ামাগার প্রতিষ্ঠারূ পরিবেশে বহু ব্যায়াম সমিতি মালদহে গড়ে ওঠে। এদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিল শুভ নারায়ন গিরির হনুমান মন্দির-এর ব্যায়াম সমিতি। এই সমিতির অবস্থান ছিল নির্জন এলাকা বাঁশবাড়ির মহানন্দা নদীর তীরে। এই অবস্থানটি ছিল বিপ্লবী কর্মকাণ্ড চালানোর সার্থক স্থান। মালদা জেলার অনুশীলন সমিতির শাখাও ছিল এই বাড়িতে। যুবকদের আশ্রয় নেওয়ার গোপন আস্তানা ছিল এই স্থানে। পাবনা থেকে ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টররূপে মনিদাস এই ব্যায়াম সমিতি পরিদর্শন করে বিপ্লবীদের বেছে নিতেন।
এছাড়াও যেসব ব্যায়াম সমিতি বিপ্লবী যুবকদের গড়ে তুলত তা হল 'পুরাটুলি ব্যায়াম সমিতি', 'অভিরামপুর ব্যায়াম সমিতি' ও 'ইংরেজবাজার ব্যায়ামসমিতি'। মূলত এই সমিতিগুলি ছিল বিপ্লবী তৈরির কারখানা। পুলিন দাস এই ব্যায়ামশালাগুলোতে নিয়মিত আসতেন। গান্ধীজীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে গৌড়বঙ্গে স্বরাজ কুটীর নামক একটি সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে যেসব যুবক স্কুল-কলেজের লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছিলেন তাঁরাই মূলত গড়ে তুলেছিলেন এই স্বরাজ কুটীর। এখানে বিভিন্ন স্থানের কর্মীরাও থাকতেন। এখানকার যুবকরা চরকা কাটা, তকলি ঘোরানো, তুলো থেকে সুতা তৈরি প্রভৃতি কাজ করত এবং স্বদেশী কাপড় তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি করতেন। চরকা আন্দোলনকে সফল করার জন্য বহু বাড়ির মেয়েদের এই কাজে যুক্ত করা হয়েছিল।
১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মালদহে গড়ে উঠেছিল 'নিখিল ভারত চরকা সংঘ'। বিজয় কুমার দাশগুপ্ত দরিদ্র অধিবাসীদের বস্তু উৎপাদন-এর জন্য সংগঠনের সাথে যুক্ত করেছিলেন। স্বাধীনতার স্পৃহার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতাকে যোগ করার উদ্দেশ্যে মকদুমপুরে 'গৌরাঙ্গ মিশন' প্রতিষ্ঠা করেন দিগিন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় 'অভয় আশ্রম'। কংগ্রেস থেকে যারা বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল করতেন তাঁরা এই আশ্রমে আসতেন। এছাড়া ঘটক বাগান ও রাজা বাগানেও বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হত।
অভিরামপুরের রেবতী মৈত্র ছিলেন কোর্টের পেশকার এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী; নিজে নাটক লিখতেন। তাঁর লেখা নাটকগুলি ছিল স্বদেশি চেতনার। তাঁর অনেক নাটক অভিরামপুর ও বি. দে. হলে মঞ্চস্থ হয়েছে। তাঁর লেখা একটি স্বদেশি চেতনার নাটক 'মায়ের পূজা' ১৯৩৩-৩৪ খ্রিস্টাব্দে অভিরামপুরে মঞ্চস্থ হয়। তাতে অভিনয় করেন খেলোয়াড় পবিত্র সেন, অভয় পাল, ক্ষিতীশ্বর দাস, রেবতী মৈত্র প্রমুখ। বিপ্লবী সংলাপ আছে বলে ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ পরে নাটকটির পান্ডুলিপি বাজেয়াপ্ত করে এবং অভিনয় বন্ধ করে দেয়। 'মায়ের পূজা' নাটকটিতে একটি গান ছিল, যার প্রথম দুই লাইন-
'রক্তে রাঙাবি শ্যামল বসুধা,
জননীর হাসি ফুটাবি আয়, আয়রে আয়।১
পত্রপত্রিকা
জাতীয় আন্দোলনের প্রভাব গৌড়বঙ্গ-এ কতটা পড়েছিল তা সম্পর্কে জানার জন্য সমকালীন গৌড় বঙ্গের পত্র-পত্রিকা একটি নির্ভরযোগ্য দলিল। উনবিংশ শতকের শেষের দিকে সংবাদপত্রের হাত ধরে দেশে জাতীয়তাবাদের এক বিপুল জোয়ার এসেছিল। গৌড় বার্তা, হিন্দু রঞ্জিকা, জ্ঞানাঙ্কুর, মালদহ সমাচার, আদ্যের
গম্ভীরা প্রভৃতি পত্র পত্রিকার মাধ্যমে গৌড়বঙ্গ তথা মালদহে ব্রিটিশ বিরোধী জনমত গঠন করা হয়েছিল। রাজশাহী থেকে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় 'ঐতিহাসিক চিত্র'। এর সম্পাদক ছিলেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্র। তিনি তখন মালদহ, দিনাজপুরের ঐতিহাসিক স্থানগুলো ভ্রমণ করে বেড়াতেন। স্বদেশি যুগে মালদহে জাতীয় শিক্ষা সমিতির সদস্যদের সাথে এই পত্রিকার যোগ ছিল। হরিদাস পালিতের 'গৌড়ীয় এনামেল ইস্টক' সমেত বেশ কিছু প্রবন্ধ এই ঐতিহাসিক চিত্রতেই প্রকাশিত হয়। ১৩
উনবিংশ শতকে মালদহে সাময়িক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন রাধেশ চন্দ্র শেঠ। তিনি ছিলেন উনিশ শতকের শেষের দিকে মালদহে দেশাত্মবোধ ও স্বদেশ ভাবনা জাগরণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরোধা। রাজশাহিতে থাকাকালীন তিনি রামপুর বোয়ালিয়া ধর্ম সভার মুখপত্র 'হিন্দুরঞ্জিকা' পত্রিকার সম্পাদক করেন। এর মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অভাব-অভিযোগ সুন্দরভাবে তার সম্পাদকীয় কলমে তুলে ধরা হয়। মালদহের মানুষকে জাতীয় জাগরণের ধারায় প্রবাহিত করতে তিনি ১৮৮৭খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করলেন 'গৌড়বার্তা' নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকা। একদিন লোকেরা মালদহ জেলাকে নিয়ে উপহাস করে বলত 'নাগর ধনুক চাঁই, তিন ছাড়া আর নাই।' মালদহের এই স্বল্প শিক্ষার পরিবেশ তিনি দেশপ্রেমের জোয়ার আনার চেষ্টা করেন এই 'গৌড়বার্তা' পত্রিকার মধ্য দিয়ে। ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে রাধেশ চন্দ্র শেঠ-এর সম্পাদনায় 'গৌড়দূত' নামক অপর একটি পত্রিকার প্রকাশ শুরু হয়। এই পত্রিকার মধ্যে ১৮৯৭ সালে মালদহের ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প-এর উল্লেখ আছে।
যতীন্দ্র চন্দ সেন গুপ্তের লেখা মালদা গেজেটিয়ার-এ উল্লেখ করা হয়েছে সে সময় প্রধান চারটি সাপ্তাহিক পত্রিকা মালদা জেলায় প্রকাশ করা হত গৌড়দূত, মালদা সমাচার, উদয়ন ও সংকল্প। তবে প্রথমদিকে এই সাময়িকী পত্রিকাগুলি জেলার মানুষের ওপর তেমন প্রভাব ফেলেনি। ঊনবিংশ ও বিংশ শতকে গৌড়দূত পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু জাতীয়তাবাদী সংবাদ ও কয়েকটি মন্তব্য ভারতীয় সংবাদপত্র এবং সাময়িকী সম্পর্কিত সরকারি প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে।১৪ এছাড়াও এই পত্রিকায় মালদহের সাহিত্য, শিক্ষা, আর্থিক অবস্থা, বাণিজ্যের প্রকৃতি, জেলার ঐতিহাসিক স্থানের বিবরণ প্রভৃতি প্রকাশ করা হত।১৫
'মালদহ সমাচার' নামক সাপ্তাহিক পত্রিকাটি ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ইংলিশ বাজার থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন কালীপ্রসন্ন চক্রবর্তী। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ জুন মালদহে গড়ে উঠেছিল 'মালদহ জাতীয় শিক্ষা সমিতি'। এর কর্ণধার ছিলেন রাধেশ চন্দ্র শেঠ। দেশে তখন স্বদেশি আন্দোলনের জোয়ার। দেশের মাটির সঙ্গে সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্প, সংগীত সব নতুন করে পাওয়ার তীব্র বাসনা জন্মালো জাতীয় বিদ্যালয় নেতৃবৃন্দের মনে। তখন মালদহের প্রাণের সম্পদ ছিল 'গম্ভীরা'। একেবারে খাঁটি জিনিস। বিনয় সরকার এই গম্ভীরার ইতিহাসকে গ্রথিত করতে চাইলেন। মালদহের স্বদেশি সংস্কৃতির ধারক গম্ভীরার সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লেখার জন্য জাতীয় শিক্ষা সমিতির তরফ থেকে মালদহ সমাচার পত্রিকায় ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে একটি বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল। যেখানে বলা হয় যদি কোন ব্যক্তি মালদহের গম্ভীরার ইতিহাস সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লিখে দেয় তবে তাতে ২৫ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও যখন কোন প্রবন্ধ পাওয়া গেল না তখন জাতীয় শিক্ষা সমিতির তরফ থেকে পুনরায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হল। তাতে গম্ভীরা সংক্রান্ত গবেষণার তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্যয় ভার বহন করা হবে এবং মাসিক বৃত্তি দেয়া হবে একথা ঘোষণা করা হয়। শেষপর্যন্ত হরিদাস পালিত লিখলেন 'আদ্যের গম্ভীরা' নামক প্রবন্ধটি। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বঙ্গীয় সাহিত্য পর্ষদ পত্রিকায় আদ্যের গম্ভীরা ছেপেছিলেন। এইসব যোগাযোগের মাধ্যম ছিল মালদহ সমাচার পত্রিকা।
এই মালদহ সমাচার পত্রিকা তখন মালদহ জেলা সমেত রাজশাহি, দিনাজপুর, রংপুর প্রভৃতি জেলায় প্রচারিত হত। সবচাইতে বেশি জনপ্রিয় ও প্রচারিত ছিল বলেই মালদহের জাতীয় সমিতি এই পত্রিকাকে বেছে নেয় বিজ্ঞাপনের জন্য। মালদহ সমাচার-এর প্রতিটি সংখ্যায় রাধেশ চন্দ্র শেঠের লেখা বের হত। সেই সময় ইংরেজ কর্মচারীদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি লেখা শুরু করেন, এর ফলে মালদহ সমাচার ইংরেজদের রোষ নজরে পরে। মালদহ সমাচার তার দেশ গঠনের ঐতিহ্য বহন করে চলেছিল। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে বিনয় কুমার সরকার 'বাংলার জাতীয় শিক্ষা পর্ষদ ও বঙ্গ সমাজ' নামে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ এই পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এর মাধ্যমে তিনি তীব্র ও উদ্দিপ্ত ভাষায় বাংলার যুবকদের স্বদেশি শিক্ষা ব্রত উদ্যাপনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। পরাধীন ভারতে মালদহের সব দিক পালেরাই এই পত্রিকায় লিখতেন। রজনীকান্ত চক্রবর্তী, বিপিনবিহারী ঘোষ, বিধুশেখর শাস্ত্রী, বানেশ্বর দাস, সুরেন্দ্রনাথ বল, কৃষ্ণচরণ সরকার, রাধাকুমুদ মুখার্জী, রাধাকমল মুখার্জী, হরিদাস পালিত এদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন।১৬
মালদহ সমাচার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই তার দেশ গঠনের ঐতিহ্য বহন করে চলেছিল। পরাধীন যুগে মালদহের অজস্র ঘটনার সাক্ষী এই পত্রিকা। স্বদেশি যুগ, অসহযোগ আন্দোলনের ইতিহাস, ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের মালদহের জনসভার বিবরণ, ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্রের মালদহের জনসভার সমস্ত কার্যাবলী, ভারত ছাড়ো আন্দোলন, দেশভাগের সম্ভাবনা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, শ্যামাপ্রসাদের মালদহ ভ্রমণ, মালদহের স্বাধীনতা ১৭ই আগস্ট ও তার সব বিবরণই এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়াও প্রকাশিত হয়েছিল গৌড় বঙ্গের শিক্ষা-সংস্কৃতির ইতিহাস। কলকাতা থেকে বহুদূরে মালদহের মত এক মফঃস্বল শহরে একটি সাময়িক পত্রিকা শত বছরের ঊর্দ্ধে অজস্র ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে নিজের প্রকাশনার প্রবাহকে ধরে রাখা এক বিরল দৃষ্টান্ত।
কত মানুষের কত অনুভূতির কথা লেখা আছে এই পত্রিকায়। শতবর্ষ স্বাধীনতার আগে এই পত্রিকার দাম ছিল দুই পয়সা এবং স্বাধীনতার পরে এর দাম হয় দুই আনা। শতবর্ষ অতিক্রম করে আজ এই পত্রিকা সঞ্জীব কুমার চক্রবর্তী সম্পাদনায় প্রকাশনার ধারা অব্যাহত রেখেছে। উত্তরবঙ্গের সাময়িক পত্রিকার ইতিহাসে এ এক গৌরবময় অধ্যায়।১৭
স্বদেশি যুগে মালদহে গম্ভীরা নামে আরেকটি দ্বিমাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে। পত্রিকাটি প্রকাশিত হত মালদহ জেলার কলি গ্রাম থেকে। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দ অবধি এই পত্রিকা চলেছিল। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন স্বদেশি যুগের অন্যতম পথিকৃত কৃষ্ণচরণ সরকার। স্বদেশি বিদ্যালয়ের উপযোগী বিভিন্ন পুস্তক রচনার বিবরণ এই পত্রিকায় প্রকাশিত হত। এছাড়া গম্ভীরা পত্রিকায় বিভিন্ন গবেষণাধর্মী প্রবন্ধও প্রকাশিত হত। মালদহ জাতীয় বিদ্যালয়ের কৃতি শিক্ষক নগেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী, খগেন্দ্রনাথ মিত্র নিয়মিত এই পত্রিকায় লিখতেন। গম্ভীরা পত্রিকার যে সংখ্যা কটি স্বদেশি যুগে প্রকাশিত হয়েছিল তার প্রতিটি সংখ্যাই আজ ইতিহাস রচনার অমূল্য সম্পদ।
মৌলানা আক্রম খাঁ সম্পাদিত 'মোহাম্মদী' নামক মাসিক পত্রিকায় জেলার মুসলিম নারী শিক্ষার বিষয়ে প্রবন্ধ লেখা হয়েছিল। এরপর চিন্তামণি চমৎকারিণী গার্লস স্কুল খোলার ফলে মুসলিম মেয়েদের জন্য শিক্ষার নতুন দুয়ার খুলে যায়। দুটি স্কুলেই মৌলবী শিক্ষকের কাছে মেয়েরা আরবী পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ৩১শে আগস্ট সংখ্যায় গৌড়দূত পত্রিকায় প্রকাশিত আরবী শিক্ষকের জন্য একটি বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়েছিল।। চাই।। মাসিক ১৫ টাকা বেতনে একজন মুসলিম ম্যাট্রিক জি. টি. শিক্ষক চাই। দরখাস্ত করুন। সেক্রেটারি সি. সি. গার্লস স্কুল মালদহ।১৯ বিজ্ঞপ্তিটি ছিল তৎকালীন নারী শিক্ষা বিস্তারের এক নির্ভরযোগ্য দলিল।
'বাঙালির ভারত বিজয়' নামক প্রবন্ধে বন্দেমাতরম সঙ্গীত, জয় হিন্দ ধ্বনি, কৃষ্ণলাল, হেমচন্দ্র, বারিন্দ্র, দ্বিজেন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র ও সুভাষচন্দ্র প্রমুখ বাঙালির স্বাধীনতায় অবদান সম্পর্কিত 'বাঙালির ভারত বিজয়' শিরোনামে ২৯ নভেম্বর ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ১৭ নং সংখ্যায় গৌড়দূত পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়।২০ মালদা জেলায় ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে জিতু সাঁওতাল বিদ্রোহ একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। স্থানীয় জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার, রাজস্ব বৃদ্ধি প্রভৃতি বিষয়গুলিকে গৌড়দূত পত্রিকায় সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছিল। ২১
মালদা জেলা কংগ্রেস ও তার আন্দোলন, ২২ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, ২৩ কমিউনিস্ট আন্দোলন ২৪ প্রভৃতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ডগুলি গৌড়দূত পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হত। জাতীয় আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলির কার্যকলাপ এই পত্রিকার মাধ্যমে প্রকাশিত হত।
🍀🍀🍀🍀🍀
Post a Comment