বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী

স্বনামধন্য বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী তার স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ জেলে ত্রিশ  বছর ও পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম নামক গ্রন্থে লিখেছেন- তারা সেই সময় টাকা তৈরি করা ও নোট জাল করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তেমন কোনো আশানুরূপ ফল বা সফল হননি। আসলে টাকা ঠিকই তৈরি হতো, তবে ছাঁচের খাঁজকাটা দিকটা তেমন উৎকৃষ্টমানের হতো না। এর ফলে একটু লক্ষ করলেই নকল টাকা ধরা পড়ে যেত। এছাড়াও টাকার আওয়াজ ও সঠিক হতো না।

তারা নোট জাল করেছিল এবং সেই নোট বাজারেও কিছু দিন চলেছিল কিন্তু জলছাপ ঠিক না হওয়ায় তা ধরা পড়ে গিয়েছিল। মূলত তাদের কাছে 100 টাকা ও 10 টাকার নোটের ব্লক তৈরি ছিল। 1924 সালে জেল থেকে মুক্তির পর তিনি কিছুদিন ঢাকাতে ও পরে ময়মনসিংহ শহরে নোট জাল করেছিলেন । ঢাকায় বিএসসি ক্লাসের একজন ছাত্র তাদেরকে এই বিষয়ে সাহায্য করত। তখন ঢাকাতে অনুশীলন সমিতির কাজ চালিয়ে ছিলেন "নোমানী'র" লেখক শ্রীমান জিতেন্দ্র লাহিড়ী । তিনি তাদের বসার এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বিপ্লবীগন নোটের কাগজ খসখসে করার জন্য এসিডি ভিজিয়ে পার্চমেন্ট করে সেই কাগজ ব্লকে ছাপিয়ে দিতেন।  বিপ্লবীদের জলছাপ ঠিক হতো না। এক সপ্তাহের মধ্যেই দাগ পড়ে যেতে। একদিন তাদের টাকার খুব প্রয়োজন ছিল। রান্না বন্ধ, তখন তিনি নতুন এক তরুণ বিপ্লবী কে তাদের ছাপানো 100 টাকার একটি নোট দিয়ে মুদি দোকানে থেকে চাল ডাল কিনে আনিয়েছিলেন। মুদি কয়েকদিন পর টের পেয়েছিলেন এটি জাল নোট। সেই সময়ে ওই নোটের জলছাপ বিকৃত হয়ে গিয়েছিল এবং একটু লাল রঙ ধরে গিয়েছিল। মুদি ভয়ে তখন এ কথা আর প্রকাশ করেন নি। কারণ, জানাজানি হলে পুলিশ তাকে টানাটানি করবে।


এই জাল নোট তৈরি কেন্দ্র ছিল কিছুদিন ঢাকা ও তারপর সেখান থেকে ময়মনসিংহ শহরে স্থানান্তরিত করা হয়। ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী তখন আত্মগোপন করেছিলেন। তাদের নোট তৈরি করার জন্য একটি বাড়ি ভাড়াও করা হয়েছিল। সেই বাড়িতে বিপ্লবী দলের কয়েকজন বিশ্বাসী কলেজের ছাত্র থাকতো। সেই বাড়িতে কোন ঠাকুর বা চাকর ছিলনা, নিজেরাই সব কাজ করতেন। ওই বাড়ি তে ত্রৈলক্যনাথ চক্রবর্তী ও প্রবোধ দাশগুপ্ত থাকতেন। তারা দ্বিপ্রহরে নোট তৈরি করত। দিনের বেলায় বাইরে বেড়োতেননা। একদিন ত্রৈলক্য বাবু সন্ধার পরে বাইরে বেরিয়ে ছিলেন এবং তার পকেটে তাদেরই তৈরি করা একটি 10 টাকার নোট ছিল। তিনি কয়েকজনের সাথে দেখা করার পর রাত দশটার সময় বিনয় চৌধুরীর বাসায় গিয়েছিলেন। বিনয় বাবু সেই সময় ছিলেন কলেজের ছাত্র। বিনয়ের সাথে আলাপ করতে করতে রাত্রি প্রায় এগারোটা বেজে গিয়েছিল। তখন বিনয় বললেন এত রাত্রে কোথায় যাবেন, এখানে শুয়ে পড়ুন। সেই রাতে ত্রৈলোক্য বাবু বিনয়ের সাথে এক লেপের তলে শুয়ে আছেন, তার কিছুক্ষণ পর কেন যেন ইচ্ছা হল পকেটের নোট টা নষ্ট করে ফেলার তখন তিনি উঠে বসে একটা দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে নোট টা পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। শেষ রাত্রে ঐ বাড়ি পুলিশ ঘেরাও করেছিল যদিও তা ত্রৈলক্য বাবুর জন্য নয়, ওই বাড়িতে অস্ত্রশস্ত্র আছে কিনা তা দেখার জন্য। পরদিন প্রাতে তারা দুজনেই ধৃত হয়েছিলেন। কিন্তু ওই বাড়িতে কোনও  আপত্তিকর জিনিস পাওয়া যায় নাই।

ঐদিন তারা গ্রেপ্তার হওয়ার পরে নোট জালের কেন্দ্র সেখান থেকে স্থানান্তরিত করে সোনারগাঁও তে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রবোধ দাশগুপ্ত ও শচীন্দ্র চক্রবর্তী নোট তৈরি করত। কিছুদিন পর প্রবোধ ও শচীন নোট জাল এর প্রেস, ব্লক, জাল নোট প্রভৃতি সহ গ্রেফতার হন। এরপর তাদের বিরুদ্ধে জাল নোট তৈরি করার অভিযোগে ঢাকায় মামলা করা হয়েছিল। ওই মামলায় প্রবোধ ও শচীন পাঁচ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন।

ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর ভাষায় ''এই জালনোট দ্বারা গভর্মেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয় নাই। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের সাধারন লোক। এই অনিচ্ছাকৃত বঞ্চনার জন্য আমরা মনে মনে বেদনাবোধ করিতাম। ডাকাতি আমরা ছাড়িয়া দিয়েছি, এখন দল চালানোর টাকা আসে কোথা হইতে? আমরা জলছাপ উন্নত করিবার চেষ্টা করিয়াছি কিন্তু সফল হই নাই।" তাদের জাল নোট ছাপানোর কাজের জন্য দেশবাসী যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সেই জন্য বিপ্লবী দল পরবর্তীতে আত্মকষ্ট  পেয়েছিলেন ।


তথ্যসূত্র : 'জেলে ত্রিশ  বছর ও পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম' - ত্রৈলক্যনাথ চক্রবর্তী।

👍👍 LIKE OUR FACEBOOK PAGE 👍👍

🎯 JOIN OUR FACEBOOK GROUP



Post a Comment

Previous Post Next Post