স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থান ও শেখ মুজিবর রহমানের ভূমিকা:
ভূমিকা: পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের বঞ্চনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মনে ক্ষোভ জমতে থাকে। এর শেষ পরিণতি হিসেবে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উত্থান ঘটে।
অর্থনৈতিক অসাম্য: পাকিস্তান সৃষ্টির তিন-চার বছর পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তান তীব্র অর্থনৈতিক বৈষম্য চাপিয়ে দেয়। পাকিস্তানের জাতীয় আয়ের সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করে পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করা হয়। তারা পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের দাবিদাওয়ার প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীনতা দেখায়। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়।
ভাষা আন্দোলন: পূর্ব পাকিস্তানে ৯৮.১৬ শতাংশের বেশি এবং উভয় পাকিস্তান মিলে ৫৬.৪০ শতাংশের বেশি মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা; অথচ পাকিস্তানের জনক মহম্মদ আলি জিন্না বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘােষণা করেন। পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনও মনে করেন যে, বাংলা হল হিন্দুদের ভাষা। এই পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষা রক্ষার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র আন্দোলন শুরু হয়।
সামরিক অসাম্য: পাক সেনাবাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা অবহেলিত ছিল। পাক সরকার বাঙালিদের ভীতু জাতি বলে মনে করত। মাত্র ৫ শতাংশ বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীতে ছিল। এদের অধিকাংশই আবার আদেশদানকারীর ন্যায় উচ্চপদে নিযুক্ত হতে পারেননি।
রাজনৈতিক অসাম্য: পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা কম হলেও দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তান কুক্ষিগত করে রেখেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের খাজা নাজিমুদ্দিন, মহম্মদ আলি বগুড়া, হােসেন শহীদ সুরাবর্দি প্রমুখ যখনই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন, তখনই পশ্চিম পাকিস্তানিরা কোনাে না কোনাে অজুহাতে তাদের পদচ্যুত করেছেন। জেনারেল আইয়ুব খা ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানে দীর্ঘ ১১ বছর ধরে স্বৈরশাসন চালিয়ে পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক অধিকার বহুলাংশে কেড়ে নেন।
১৯৭০-এর নির্বাচন: ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামি লিগ দল ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তারা সেখানকার ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসনে জয়লাভ করে এবং পাকিস্তানে সরকার গঠনের অধিকার পায়। কিন্তু ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানের সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তানের কোনাে ব্যক্তির হাতে পাকিস্তানের ক্ষমতা ছাড়তে রাজি ছিলেন না। তা ছাড়া নির্বাচনে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত। দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো অনৈতিকভাবে আওয়ামি লিগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষমতা লাভের বিরােধিতা করেন।
শেখ মুজিবরের নেতৃত্ব: সরকার গঠনে আওয়ামি লিগ ব্যর্থ হলে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। শেখ মুজিবরের ধর্মঘটের ডাকে গােটা পূর্ব পাকিস্তান অচল হয়ে পড়ে। মুজিবুর ২৫ মার্চ (১৯৭১ খ্রি.) ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের এক সভার ঐতিহাসিক ভাষণে ঘােষণা করেন যে, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” তাঁর ভাষণে পূর্ববঙ্গের গােটা বাঙালি জাতির মধ্যে উন্মাদনার সৃষ্টি হয়।
গণহত্যা: বেলুচিস্তানের কসাই নামে পরিচিত জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর করে ঢাকায় পাঠানাে হয়। পূর্ব পাকিস্তানে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ আনা হয়। ২৫ মার্চ রাতে পাক সামরিক বাহিনী বাঙালিদের ব্যাপক হারে হত্যা করতে শুরু করে। এই হত্যা অভিযানের পােশাকি নাম দেওয়া হয় 'অপারেশন সার্চ লাইট'।
স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম: ২৫ মার্চ মধ্যরাতে শেখ মুজিবুর গ্রেপ্তার হলেও আন্দোলন দমন করা যায়নি। স্বাধীনতা আদায়ের লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ও মুক্তি বাহিনী ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির নেতৃত্বে ভারতীয় সেনা পূর্ববঙ্গে মুক্তি বাহিনীকে সহায়তা শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই পাক বাহিনী বিপাকে পড়ে যায়। শেষপর্যন্ত পাক বাহিনীর প্রধান জেনারেল এ. এ. কে. নিয়াজি ভারতীয় বাহিনীর প্রধান জগজিৎ সিং অরােরার কাছে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করেন এবং স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম হয়।
উপসংহার: স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও বাংলাদেশে রাজনৈতিক সুস্থিতি অধরাই থেকে যায়। স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট আততায়ীর হাতে নিহত হন।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান:
জনসমর্থন ও সহযােগিতা প্রদান
শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদান
মুক্তিযােদ্ধাদের ট্রেনিং প্রদান
কূটনৈতিক সহযােগিতা
কূটনৈতিক দিক থেকেও মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান রয়েছে। জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব হেনরী কিসিঞ্চার ভারত সফর করে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সহযােগিতা প্রত্যাহারের অনুরােধ করলে প্রত্যাখান করেন। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় মধ্যস্থতার পথ রুদ্ধ হয় এবং এর ফলে ভারত তার নিজস্ব বিবেচনায় চলতে থাকে। জুলাই মাসে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তান সহযােগিতায় পৌঁছালে সােভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়ে ভারত। ৯ আগস্ট রুশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশ সংক্রান্ত ভারতের নীতি ও কর্মসূচীর পরিবর্তন দেখা যায় । ইন্দিরা গান্ধী সেপ্টেম্বরে রাশিয়া সফর করলে মস্কো-দিল্লী চুক্তির আওতায় ভারতকে সহায়তার আশ্বাস দেয়া হয়। ফলে বাঙালি বিরােধী যেকোন আন্তর্জাতিক সমাধানের বিরুদ্ধে ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়ন তৎপর হয়ে উঠে।
সামরিক অভিযান প্রেরণ
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস শরণার্থীদের আশ্রয়, মুক্তিযােদ্ধাদের ট্রেনিং ও অস্ত্র দিয়ে, প্রবাসী সরকার গঠনে সহায়তা করে, আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন করে, সর্বোপরি চূড়ান্ত পর্বে যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে এসবের পিছনে নিছক ভালােবাসা বা সহানুভূতির অনুভূতিই যে প্রধান ছিল একথা সত্যি নয়। এর পিছনে ভারতের জাতীয় স্বার্থের বিষয়টিও অনেক ক্ষেত্রে জড়িত ছিল, যা ভারতকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে ত্বরিত করেছিল। মােটকথা ভারত সরকারের নীতির কিছু স্বার্থবাদী দিক থাকলেও এগুলাে ছিল বৈদেশিক নীতিরই একটি অংশ। কেননা, একমাত্র দেশ ভারত যে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা রেখেছে। তাই মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।
🌿
[বি. দ্র. - পরীক্ষার যে অংশটা আসবে শুধুমাত্র সেই অংশটাই লিখতে হবে। যদি দুটি অংশই আসে তাহলে প্রত্যেকটা অংশকে ছোট ছোট করে লিখতে হবে]
Post a Comment