Q. উপনিবেশিক ভারতবর্ষের অবশিল্পায়নের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো।
ASSISTANT TEACHER OF HISTORY
অবশিল্পায়ন:
যখন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে ওঠার পরিবর্তে দেশের প্রতিষ্ঠিত শিল্প কারখানাগুলিই ধ্বংসের মুখে পতিত হয় তখন তাকে অবশিল্পায়ন বলে। পলাশির যুদ্ধের পরবর্তী একশো বছর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শোষণ ও নিপীড়ন, ব্রিটিশ পণ্যের অবাধ আমদানি, বৈষম্যমূলক শুল্ক নীতি প্রভৃতির ফলে চিরাচরিত ভারতীয় কুটিরশিল্প ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে ভারতীয় অর্থনীতিতে শিল্প নির্ভরতা হ্রাস পায় এবং কৃষি নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়। ঐতিহাসিকগণ এই অবস্থাকে অবশিল্পায়ন (De-industrialization) বলেছেন।
■ ঔপনিবেশিক ভারতে অবশিল্পায়নের কারণ:
অবশিল্পায়নের কারণ হিসেবে রমেশচন্দ্র দত্ত, রজনী পাম দত্ত, নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিনহা, বিপান চন্দ্র, অমিয় বাগচী বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন। যেমন-
• দাদন প্রথা:
দেওয়ানি লাভের পর থেকে ব্রিটিশ কোম্পানির দালাল ও গোমস্তারা তাঁতিদের দাদন বা অগ্রিম দিত। এরপর তারা তাঁতিদের জোর করে ব্রিটিশ কোম্পানিকে মাল বিক্রির চুক্তিপত্রে সই করতে বাধ্য করত। অনেক সময় শতকরা 40 টাকা পর্যন্ত কম দাম দিয়ে তারা তাঁতিদের থেকে কাপড় কিনে নিত।
• দস্তকের অপব্যবহার:
দস্তক হল বিনাশুল্কে ব্যাবসা করার বাণিজ্যিক ছাড়পত্র। ব্রিটিশ কোম্পানি এই ছাড়পত্র দেখিয়ে বাংলায় বিনা শুল্কে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য চালাতে পারত। কিন্তু কোম্পানির কর্মচারীগণ ব্যক্তিগত ব্যাবসার ক্ষেত্রে এই দস্তক ব্যবহার করতে থাকে। ফলে দেশীয় বণিকরা কঠিন সমস্যায় পড়ে বাণিজ্য বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়। পাশাপাশি কোম্পানির মূল লক্ষ্য ছিল যত কম দামে সম্ভব ভারতের বস্ত্র কিনে ইউরোপের বাজারে চড়া দামে বিক্রি করা। যার পরিণতিতে ভারতীয় তাঁতিরা চরম লোকসানের সম্মুখীন হয়।
• তুলার দাম বৃদ্ধি:
ব্রিটিশ কোম্পানির কর্মচারীরা তাঁতিদের কাছে চড়া মূল্যে তুলা বিক্রি করত। এদিকে তাঁতিরা চড়া দামে তুলা কিনে সস্তা দামে কাপড় বিক্রি করতে বাধ্য হত। ফলে তারা সর্বস্বান্ত হয়ে যেত।
• 1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন:
1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন অনুসারে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার হারায়। শুরু হয় মুক্ত বাণিজ্য নীতি। এর ফলে ইউরোপের শিল্প কারখানায় প্রস্তুত বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী ভারতের বাজার ছেয়ে ফেলে। বিদেশি পণ্যের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় ভারতের শিল্পসামগ্রী পিছু হঠতে থাকে।
• শিল্পবিপ্লবের প্রভাব:
ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্ত, নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিনহা, অমিয় বাগচী প্রমুখ মনে করেন, ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবই দেশীয় শিল্পের অবক্ষয়ের প্রধান কারণ। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, "ইউরোপের পাওয়ার লুমের আবিষ্কার, ভারতীয় শিল্পের ধ্বংসসাধনকে সম্পূর্ণ করেছে।"
• অসম শুল্ক নীতি:
ইংল্যান্ডের শিল্পকে রক্ষা ও ভারতের শিল্পকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বৈষম্যমূলক শিল্প নীতি গ্রহণ করে। ইংল্যান্ডের শিল্পসামগ্রী যাতে অবাধে ভারতে আসতে পারে তার জন্য আমদানি শুল্ক কমিয়ে রপ্তানি শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়। যেখানে আমদানি শুল্ক ধার্য করা হয় 2%, সেখানে রপ্তানি শুল্ক 50% ধার্য করা হয়।
• দেশীয় শাসকদের আর্থিক সংকট:
দেশীয় রাজা, জমিদার সুতিবস্ত্রের প্রধান ক্রেতা ছিলেন। বস্ত্র শিল্পের ক্ষেত্রে আর্থিক সংকটের কারণে এই ক্রেতারা লুপ্ত হয়ে যায়। এ ছাড়া এতকাল কারখানাতেই অস্ত্র তৈরি হত। কিন্তু ব্রিটিশ কোম্পানির শাসনে অস্ত্রশস্ত্র ব্রিটেন থেকে আসতে থাকে। ফলে অস্ত্র কারিগরদেরও রুজি বন্ধ হয়ে যায়।
• বিলাতি পণ্যের প্রতি ঝোঁক :
অর্থনীতিবিদ গ্যাডগিল দেখিয়েছেন, ওই সময়ে ভারতের ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিলাতি পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। স্বভাবতই এর ফলে দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
■ অবশিল্পায়নের ফলাফল:
ভারতে অবশিল্পায়নের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। যেমন-
• বেকারত্ব বৃদ্ধিঃ
দেশীয় কুটিরশিল্প ধ্বংসের ফলে ভারতের বহু তাঁতি ও কারিগর বেকার হয়ে যায়। নরেন্দ্রকৃঘ্ন সিনহার মতে, শুধুমাত্র বাংলাতেই দশ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছিল। কাজের ক্ষেত্রে অনেকে দেশান্তরী হয়। এককথায় অবশিল্পায়নের ফলে দেশে একটি কর্মহীন জনসমাজ তৈরি হয়।
• কৃষি জমির ওপর চাপ বৃদ্ধি:
অবশিল্পায়নের ফলে ভারতীয় অর্থনীতিতে শিল্প নির্ভরতা হ্রাস পায় এবং কৃষি নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়। স্বাভাবিক কারণেই কৃষিজমির ওপর চাপ বৃদ্ধি পায়। ফলে ভারত শিল্প প্রধান দেশ থেকে কৃষি প্রধান দেশে পরিণত হয়।
• কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশ:
অবশিল্পায়নের ফলে ভারত একটি কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়। ভারতের কাঁচা তুলো, রেশম, নীল, পাট, চা প্রভৃতি ইংল্যান্ডের বণিকরা সস্তায় ক্রয় করে ইংল্যান্ডে রপ্তানি করতে থাকে।
• সামাজিক ভারসাম্যে আঘাত:
অবশিল্পায়নের ফলে গ্রামীণ সমাজ কাঠামো ভেঙে পড়ে। বহু শহর শ্রীহীন হয়ে পড়ে। শহর থেকে মানুষ গ্রামমুখী হতে থাকে। ফলে সামাজিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়।
• দারিদ্রতা বৃদ্ধি:
অবশিল্পায়নের অনিবার্য ফলশ্রুতি ছিল ভারতে দারিদ্রতা বৃদ্ধি। শিল্প, বাণিজ্য ধ্বংসের কারণে দেশের অর্থনীতিতে আঘাত আসে। যার চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে ভারত একটি দরিদ্র দেশে পরিণত হয়। দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ, মহামারি ভারতীয় জনজীবনে নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে।
■ উপসংহার:
1813 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারত ছিল মূলত রপ্তানিকারক দেশ। কিন্তু অবশিল্পায়নের ফলে ভারত পরিণত হয় আমদানিকারক দেশে। ভারতবাসীকে জীবনধারণের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির জন্য ব্রিটেনের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। ভারত পরিণত হয় পণ্যসামগ্রী আমদানিকারক এবং কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে।
Post a Comment