ভুমিকা 

উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারীসমাজের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ লক্ষ্ করা যায় । ভগিনী নিবেদিতা ভারতের বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা যোগাতেন । যুগান্তর ও অনুশীলন সমিতির সাথে তার প্রত্যক্ষ যোগ ছিল । ভারতের বিপ্লববাদের জননী মাদাম কামা ভারতের বাইরে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন সংগঠনে ভূমিকা নেন । অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পরবর্তীকালে দিপালী সংঘের মহিলা সদস্যরা যেমন— প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত সহ অনেকেই সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েন ।


লীলা নাগ

বিশ শতকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নারীদের শামিল করার কাজে সুভাষচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ চরম বামপন্থী রাজনীতিক লীলা নাগ (রায়) -এর অসামান্য অবদান রয়েছে । তিনি ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় 'দীপালি সংঘ' নামে একটি নারী সংগঠনের প্রতিষ্ঠা করেন । 

ভারতে প্রথম তার মাধ্যমে ছাত্রীদের মধ্যে রাজনীতি চর্চা শুরু করেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মহিলাদের আবাস ‘ছাত্রীভবন’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনের সময় তার উপর নারী আন্দোলনের ইতিহাস রচনার দায়িত্ব অর্পিত হয়। ফরোয়ার্ড ব্লক গঠিত হলে তিনি এই সংগঠনে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলনে কারারুদ্ধ হন। 



কারামুক্তির পর সুভাষচন্দ্রের নির্দেশে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ সাপ্তাহিকের সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে নেতাজীর অন্তর্ধানের পর তিনি ও তার স্বামী অনিল রায় উত্তর ভারতে ফরওয়ার্ড ব্লক সংগঠনের দায়িত্ব নেন। [৮] তিনি মহিলা সমাজের মুখপত্র হিসেবে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে “জয়শ্রী” নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের করেন। লীলা রায় ছবি আঁকতেন এবং গান ও সেতার বাজাতে জানতেন। দেশভাগের দাঙার সময় তিনি নোয়াখালীতে গান্ধীজীর সাথে দেখা করেন। তিনি দীপালী সংঘ নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।


প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার

 প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ছিলেন দীপালি সংঘের অন্যতম সদস্যা । এই সংঘের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য নারীদের প্রস্তুত করে তোলা । এখানে লাঠি খেলা, শরীরচর্চা, অস্ত্র চালনা প্রভৃতি শিক্ষণ দেওয়া হত । তার ডাকনাম রাণী, ছদ্মনাম ফুলতারা, একজন বাঙালি ছিলেন, যিনি ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নারী মুক্তিযোদ্ধা ও প্রথম বিপ্লবী শহীদ ব্যক্তিত্ব। তৎকালীন পূর্ববঙ্গে জন্ম নেয়া এই বাঙালি বিপ্লবী সূর্য সেনের নেতৃত্বে তখনকার ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং জীবন বিসর্জন করেন। 



১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব দখলের সময় তিনি ১৫ জনের একটি বিপ্লবী দল পরিচালনা করেন। এই ক্লাবটিতে একটি সাইনবোর্ড লাগানো ছিলো যাতে লেখা ছিলো "কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ" প্রীতিলতার দলটি ক্লাবটি আক্রমণ করে এবং পরবর্তীতে পুলিশ তাদেরকে আটক করে। পুলিশের হাতে আটক এড়াতে প্রীতিলতা সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।



কল্পনা দত্ত 

১৯২০ -র দশকের অন্যতম নেত্রী ছিলেন কল্পনা দত্ত । তিনি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে 'ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি'র চট্টগ্রাম শাখায় যোগ দেন । তিনি ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের দায়িত্ব পান । কিন্তু আক্রমণের এক সপ্তাহ আগেই পুলিশের হাতে ধরা পড়েন । 

তিনি চট্টগ্রাম বিপ্লবের একজন অন্যতম বিপ্লবী নেত্রী শহীদ ক্ষুদিরাম এবং বিপ্লবী কানাইলাল দত্তের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি বেথুন কলেজ-এ গড়ে ওঠা ছাত্রী সংঘ-এ যোগদান করেন। পূর্ণেন্দু দস্তিদারের মাধ্যমে তিনি মাস্টার দা সূর্য সেনের সাথে পরিচিত হন এবং মাস্টার দা প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখা-য় যোগদান করেন। তার বিপ্লবী মনভাবের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে 'অগ্নিকন্যা' বলেছেন।

 এই সময় বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের বিচার ও সাজা রুখতে তিনি বেশ কিছু সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তিনি কোর্ট এবং জেলে ডিনামাইট দ্বারা বিষ্ফোরনের পরিকল্পনা করেছিলেন, যাতে বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ পালাতে সক্ষম হন। কিন্তু তার পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়। ফলে তার বিপ্লবী কর্মকান্ডের উপর কিছু প্রতিবন্ধকতা আসে। যাই হোক এই সময় তিনি প্রায়ই মাস্টার দার সাথে তার গ্রামে ঘুরে গ্রামের মানুষের সুখ দুঃখের খবর নিতেন। এরই সাথে সাথে তিনি ও তার সহযোদ্ধা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রত্যহ গুলি চালনার প্রশিক্ষন নিতেন।



১৯৩১ সালে সূর্য সেন, কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে চট্টগ্রামের ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের দায়িত্ব দেন। নির্দিষ্ট দিনের এক সপ্তাহ আগে পুরূষের ছদ্মবেশে একটি সমীক্ষা করতে গিয়ে তিনি ধরা পরেন ও গ্রেফতার হন। জেলে বসে তিনি অপারেশন পাহারতলী এবং বীরাঙ্গনা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের আত্মহত্যার খবর শোনেন।

জামিনে মুক্তি পেয়ে মাস্টার দার নির্দেশে তিনি কিছু দিন আত্মগোপন করে থাকেন। ১৯৩৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পুলিশ তাদের গোপন ডেরা ঘিরে ফেলে। কল্পনা এবং মনিন্দ্র দত্ত পালাতে সক্ষম হলেও মাস্টার দা বন্দী হন। কিছুদিন পর কল্পনা এবং তার কিছু সহযোদ্ধা পুলিশের হাতে ধরা পরেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলায় মাস্টার দা ও তারকেশ্বর দস্তিদারকে মৃত্যুদন্ডে দণ্ডিত করা হয়। কল্পনা দত্ত যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দণ্ডিত হন।


বীণা দাস

বীণা দাস ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব এবং অগ্নিকন্যা। বীণা দাসের পরিবার রাজনৈতিক পরিবার। অসহযোগ ও জাতীয় আন্দোলনের যোগ দেওয়ার কারণে তার দাদা কারাবরণ করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি রাজনৈতিক মনস্ক হয়ে ওঠেন। সে সময় যুগান্তর দল এর কতিপয় সদস্যের সাথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশন বয়কট করার জন্য বেথুন কলেজের ছাত্রীদের নিয়ে উঠে-পড়ে লেগেছিলেন। ১৯৩০ সালে ডালহৌসির অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য ছোট ছোট দলের নেতৃত্ব দেন এবং গ্রেপ্তার হন। 


বীণা দাস ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবের নেত্রী ছিলেন এবং ১৯৩২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর সমাবর্তনে বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনের উপর পিস্তল দিয়ে গুলি চালান। এইসময় জ্যাকসনকে রক্ষা ও বীণা দাসকে ধরে ফেলার কৃতিত্ব অর্জন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার হাসান সোহরাওয়ার্দী। এই হত্যা প্রচেষ্টা চালানোর কারণে ৯ বছর কারাবরণ করেন বীণা দাস। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ কলকাতার কংগ্রেসের সম্পাদিকা ছিলেন তিনি। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য ছিলেন। নোয়াখালির দাঙ্গার পরে সেখানে তিনি রিলিফের কাজ করতেন। স্বাধীনতার পরেও সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজে নিজেকে ব্যপ্ত রাখেন। মরিচঝাঁপি গণহত্যার সময় তিনি প্রতিবাদী হন।



মূল্যায়ন 

তবে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের অংশ গ্রহণের বিষয়ে দেখা যায় যে মূলত শিক্ষিত নারীরাই এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন । তাছাড়া নারীদের বিপ্লবী আন্দোলনে বাংলাই সবচেয়ে এগিয়ে ছিল ।

অন্যান্য লেখা -

১) দেশভাগ সম্পর্কিত আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা

২) ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ বা সিপাহী বিদ্রোহ

৩) ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহ মক টেস্ট

৪) হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও ও নব্য বঙ্গ আন্দোলন

৫) AITUC

Like our Facebook Page



Post a Comment

Previous Post Next Post