Q. ব্রিটিশ ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো। অথবা,
Q. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভারতের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো
Shuvajoy Roy
M.A/B.Ed/Net/Set
Department of History & Culture
YouTube : The History Exploring
ভূমিকা:
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালের প্রথম দিকে ভারত ছিল কৃষিপ্রধান দেশ। 1765 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা সুবার 'দেওয়ানি' অধিকার অর্জন করে রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা পায়। অতঃপর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের উৎসাহে ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সক্রিয় প্রচেষ্টায় ভারতের নানা প্রান্তে বিভিন্ন ভূমি রাজস্ব নীতি গৃহীত হয়।
■ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভারতে ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা:
• রবার্ট ক্লাইভের ভূমিরাজস্ব নীতিঃ
ভারতের ভূমিরাজস্ব সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় ক্লাইভ বাংলায় দেওয়ানি লাভের পর প্রচলিত ব্যবস্থাই চালু রাখেন। রাজস্ব আদায়ের ভার দেওয়া হয় সীতাব রায় ও রেজা খাঁর ওপর। তাঁরা বাংলায় রাজস্ব আদায়ের নামে শোষণ শুরু করেন। পরবর্তীকালে ওয়ারেন হেস্টিংস ও লর্ড কর্নওয়ালিশ ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় বেশ কিছু পরিবর্তন সাধন করেন।
• ওয়ারেন হেস্টিংসের ভূমিরাজস্ব নীতি:
ওয়ারেন হেস্টিংস 1772 খ্রিস্টাব্দে বাংলার গভর্নর জেনারেল হয়ে এসে প্রথমে বাংলার ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কারে উদ্যোগী হল। তিনি প্রথমে সীতাব রায় ও রেজা খাঁকে পদচ্যুত করেন। ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্তকে গতিশীল করার জন্য তিনি নানা পরীক্ষানিরীক্ষাও শুরু করেন। যেমন-
• পাঁচসালা ব্যবস্থা:
ওয়ারেন হেস্টিংস বোর্ড অব রেভিনিউ গঠন করে তার নির্দেশ অনুসারে 1772 খ্রিস্টাব্দে পাঁচসালা বন্দোবস্ত চালু করেন। এই ব্যবস্থানুসারে যে ব্যক্তি নিলামে সর্বোচ্চ রাজস্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেবে তাকে পাঁচ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। কিন্তু এতে রাজস্ব আদায়ের নামে কৃষকদের ওপর অত্যাচার বৃদ্ধি পায়। ফলে 1777 খ্রিস্টাব্দে এই ব্যবস্থা বাতিল করা হয়।
• একসালা বন্দোবস্ত:
এরপর হেস্টিংস রাজস্ব নির্ধারণ ও আদায়ের উদ্দেশ্যে আমিনি কমিশন গঠন করেন। এই কমিশনের সুপারিশক্রমে বাংলায় একসালা বন্দোবস্ত চালু করেন। একসালা বন্দোবস্ত কৃষকদের দুরাবস্থার কোনো সমাধান করতে পারেনি। 1777 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1789 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই ব্যবস্থা চালু ছিল।
• লর্ড কর্নওয়ালিশের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা:
1786 খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিশ বাংলার গভর্নর জেনারেল হয়ে আসার পর 1789-90 খ্রিস্টাব্দে তিনি জমিদারদের সঙ্গে রাজস্ব আদায়ের প্রশ্নে 'দশসালা বন্দোবস্ত' চালু করেন। সেই সঙ্গেঙ্গ ঘোষণা করেন যে, লন্ডনস্থ কোম্পানির অনুমোদন পেলে এই ব্যবস্থা চিরস্থায়ী করা হবে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত:
ব্রিটিশ কোম্পানির বোর্ড অব রেভিনিউ এর দুই প্রভাবশালী সদস্য স্যার জন শোর এবং চার্লস গ্রান্টের সঙ্গে পরামর্শ করে লর্ড কর্নওয়ালিশ বাংলা সুবায় দশসালা বন্দোবস্তুকে 1793 খ্রিস্টাব্দের 22 মার্চ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কথার অর্থ জমিদারের সঙ্গে কোম্পানির ভূমিরাজস্ব বিষয়ে স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ।
• উদ্দেশ্য:
(১) চিরকালের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব লাভ, (ii) ব্রিটিশ কোম্পানির অনুগ্রহপুষ্ট একটি অভিজাত শ্রেণি গড়ে তোলা যারা সরকারের সমর্থক হিসেবে কাজ করবে, (iii) জমিদারদের বংশানুক্রমিক মালিকানা স্বত্ব প্রদানের মাধ্যমে কৃষি ও কৃষকের উন্নতি সাধন করা।
• সুফল:
(1) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ব্রিটিশ কোম্পানির বার্ষিক আয় নির্দিষ্ট হওয়ায় তাদের পক্ষে বার্ষিক বাজেট প্রস্তুত করতে সুবিধা হয়, (ii) এই ব্যবস্থায় এক জমিদার শ্রেণির উদ্ভব হয়, যার ইংরেজদের অনুগত থেকে ইংরেজ রাজত্বের ভীতকে মজবুত করেছিল, (iii) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদার জমির মালিক বলে পরিগণিত হওয়ায় অনেকক্ষেত্রে জমি ও কৃষকদের উন্নতি ঘটেছিল।
• কুফল:
(1) উচ্চহারে রাজস্ব দেওয়ার শর্তে অনেক জমিদার জামিদারি ক্রয় করেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে বছর শেষে প্রতিশ্রুত পরিমাণ অর্থ জোগাড় করতে না পারায় অনেকে জমিদারি হারান, (ii) জমিদারদের ইচ্ছা মতো রাজস্ব আদায় বা ঘনঘন জমিদার পরিবর্তনের ফলে কৃষকদের দুর্দশার অন্ত ছিল না।
• রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত:
ভারতের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে আলেকজান্ডার রিড ও স্যার টমাস মনরোর যৌথ উদ্যোগে 1820 খ্রিস্টাব্দে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয়। এই বন্দোবস্তে সরকারের সঙ্গে কৃষকদের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়। কৃষকরা সরাসরি সরকারকেই রাজস্ব দিত-কোনো জমিদার বা মধ্যস্বত্বভোগীর মাধ্যমে নয়। সাধারণত 30 বছর অন্তর রাজস্বের হার পরিবর্তন করা হত। যদিও এই ব্যবস্থায় জমির ওপর কৃষকের মালিকানা স্বত্ব ছিল না-ছিল ভোগ দখল করার স্বত্ব। রায়তওয়ারি ব্যবস্থায় কৃষকেরা জমিদারদের পরিবর্তে সরকারি কর্মচারীদের অত্যাচারের স্বীকার হয়।
• মহলওয়ারি বন্দোবস্ত:
গাঙ্গেয় উপত্যকা, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ও মধ্যভারতের কিছু অংশে এলফিনস্টোনের উদ্যোগে 1822 খ্রিস্টাব্দে মহলওয়ারি বন্দোবস্ত চালু হয়। এই ব্যবস্থা ছিল জমিদারি প্রথার অনুরূপ। এই প্রথা অনুসারে কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি মহল বা তালুক সৃষ্টি করা হত এবং কোনো একজন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে যৌথভাবে রাজস্ব দেওয়ার শর্তে ওই মহলের ইজারা দেওয়া হত। এই বন্দোবস্তের কিছুদিন পর ভূমিরাজস্ব পুননির্ধারণ করা হত। এই বন্দোবস্তে রাষ্ট্রের চাহিদার কোনো ঊর্ধ্বসীমা টানা হয়নি। ফলে কৃষকদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে।
• ভাইয়াচারি বন্দোবস্ত:
উনবিংশ শতাব্দীর পাঞ্জাবে এই বন্দোবস্ত প্রচলিত ছিল। এই বন্দোবস্ত অনুসারে গ্রামের প্রত্যেক চাষির ওপর পৃথক পৃথক ভাবে রাজস্ব ধার্য করা হত। ওই রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব গ্রামেরই এক ব্যক্তির ওপর ন্যস্ত হত। এই বন্দোবস্তে কয়েক বছর অন্তর অন্তর রাজস্বের হার পরিবর্তন করা হত।
উপসংহারঃ
ভূমিরাজস্ব নির্ধারণ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নানা পরীক্ষানিরীক্ষা ভারতীয় কৃষক সমাজের ওপর নানা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। আসলে ভারতে ভূমিরাজস্ব নীতি ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল। ভারতের উন্নত অর্থনৈতিক পরিকাঠামো গড়ে তোলার সঙ্গে এই ব্যবস্থা কোনোভাবেই যুক্ত ছিল না। সরকারি মদতে জমিদাররা হয়ে উঠেছিল কৃষক শোষণের যন্ত্র। এক কথায় ব্রিটিশ কোম্পানির আমলে গৃহীত ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা নীতির ফলে ভারতের কৃষি অর্থনীতি ধ্বংসের মুখে চলে যায়।
💠💠💠💠
Post a Comment