Q. ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর এবং এই আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।  (HS-2017)

Shuvajoy Roy

M.A/B.Ed/Net/Set

Department of History & Culture 

YouTube : The History Exploring


 ■ ভূমিকা: 

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্তিম পর্যায়ের। সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ছিল ভারত ছাড়ো আন্দোলন (1982 খ্রিস্টাব্দে)। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও স্বাধীনতার জন্য কঠোর সংকল্পের প্রকাশ ছিল এই আন্দোলন।


■ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য:

ভারত ছাড়ো আন্দোলন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারলেও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই আন্দোলনের গুরুত্ব বা তাৎপর্য অপরিসীম। কারণ,


• জাতীয় কংগ্রেসের প্রভাব বৃদ্ধি: 

জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুভ হয়েছিল। এই আন্দোলনের ব্যাপকতায় কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতাদের গ্রেফতার, গান্ধিজির অনশনে দেশবাসীর অন্তরে কংগ্রেসের প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য বৃদ্ধি করে। এর ফলে কংগ্রেসের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি ফুটে ওঠে।


• গণ আন্দোলন: 

এই আন্দোলন ছিল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। ড. অমলেশ ত্রিপাঠির মতে এই আন্দোলন অনেক স্থানে ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং জনতাই ছিল নেতা। ব্রিটিশ সরকারের কাছে এই সত্য স্পষ্ট হয়েছিল যে, জাতীয় কারণে ভারতবাসী আত্মত্যাগ করতেও প্রস্তুত। জওহরলাল নেহরু লিখেছেন, "নেতা নেই, সংগঠন নেই, উদ্যোগ আয়োজন কিছুই নেই, কোনো মন্ত্রবল নেই অথচ একটি অসহায় জাতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্ম প্রচেষ্ঠার বিকল্প পথ না পেয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠল-এই দৃশ্য সত্যিই বিস্ময়কর।" অর্থাৎ ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল প্রকৃতই ভারতবাসীর গণ সংগ্রাম।


• সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি: 

মুসলিম লিগ এই আন্দোলনে যোগ না দিলেও বহু মুসলিম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই আন্দোলনে শামিল হয়েছিল। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, চট্টগ্রাম, শিলচর প্রভৃতি স্থানে বহু মুসলিম এই আন্দোলনে অংশ নেয়। এই সময় কোনো সাম্প্রদায়িক সমস্যার সৃষ্টি হয়নি। ঐতিহাসিক ডি.এন.পানিগ্রাহী যথার্থই মন্তব্য করেছেন, "মুসলিম লিগের সাহায্য ও সহযোগিতা না থাকলেও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সাধারণ মুসলিম জনগণ সক্রিয়ভাবে এই আন্দোলনে শামিল হয়েছিল।"


• স্বাধীনতার প্রস্তুতি: 

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ভারতবাসী স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত এবং তা অর্জনের জন্য মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত। অম্বাপ্রসাদ বলেন যে, "1942 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও তা 1947 খ্রিস্টাব্দে ভারতের স্বাধীনতার ভিত্তি প্রস্তুত করে।"


• ক্ষমতার হস্তান্তরের প্রস্তুতি: 

বড়োলাট লর্ড ওয়াভেল ইংল্যান্ডের সরকারকে লেখেন, "ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দিন শেষ হয়েছে। পুনরায় এই ধরনের একটি আন্দোলন হলে তা মোকাবিলা করার শক্তি সরকারের নেই। ব্রিটিশ সরকার আয়ারল্যান্ড ও মিশরে যেভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে, ভারতে এখনই তা করা দরকার।" অর্থাৎ ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাথমিক চিন্তাভাবনায় ভারত ছাড়ো আন্দোলন প্রভাব ফেলেছিল এ কথা বলা যায়।


■ মূল্যায়ন: 

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততা, ব্যপকতা এবং গণ অংশ গ্রহণের চরিত্র স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে, ভারতের স্বাধীনতা এমন সময়ের অপেক্ষামাত্র। এই আন্দোলন ছিল ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে ভারতবাসীর চূড়ান্ত বার্তা।


■ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ: 


ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও জাতীয় আন্দোলনে তাদের ভূমিকা অধিকতর স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ঊষা মেহতা, অরুণা আসা আলি, সুচেতা কৃপালনী, মাতঙ্গিনি হাজরা, বীণা দাস, হেলেনা দত্ত, প্রতিমা দাস, উজ্জ্বলা মজুমদার-এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।


• মধ্যবিত্ত নারীদের যোগদান: 

এই আন্দোলনে স্কুলকলেজের ছাত্রীসহ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নারীরা প্রকাশ্যে ও গোপনে দুধরনের আন্দোলনেই যুক্ত হয়েছিল। যেমন-ঊষা মেহতা বোম্বাইয়ে গোপণ রেডিয়ো কেন্দ্র গড়ে তুলে গান্ধিজির 'করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে' আদর্শসহ জাতীয় আদর্শ প্রচার করতেন।


• অরুণা আসফ আলি: 

নারীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অরুণা আসফ আলির ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অরুণা আসউ আলি গোপনে জাতীয় আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন এবং 1942 খ্রিস্টাব্দের ৭ আগস্ট বোম্বাইয়ের আগস্ট ক্রান্তি ময়দানে তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলন করেন।


• মাতঙ্গিনি হাজরা: 

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে মেদিনীপুরের মাতঙ্গিনি হাজরা তমলুক থানা দখল অভিযানে একটি সুবিশাল মিছিলের নেতৃত্ব দেন এবং পুলিশের গুলিতে মারা যান। তিনি বন্দেমাতরম্ ধ্বনি দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।


• ভাগিনী সেনা: 

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় বাংলার মেদিনীপুরে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি গ্রামীণ মহিলারা ব্রিটিশবিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য নারী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। এইরূপ সংগঠন 'ভগিনী সেনা' নামে পরিচিত ছিল। ভগিনী সেনার অনেক নারী জেলবন্দি হন।


■ উপসংহার: 

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে বাংলা বোম্বাই, আসাম, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, কর্ণাটকে অংশগ্রহণকারী নারীদের অধিকাংশই কংগ্রেস দলের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভুত ছিলেন। এই আন্দোলনে কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টির মহিলারা যতটা সক্রিয়তা দেখিয়েছিলেন, সেই তুলনায় বামপন্থী মনোভাবাপন্ন ও কমিউনিস্ট দলের নারী সদস্যদের যোগদান ছিল খুবই সীমিত।


🌟💠🌟💠🌟

Post a Comment

Previous Post Next Post